খাদ্য বা খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস ইদানীং কালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তার একটি কারণ হয়তো মানুষের যাপনের ইতিহাসের সঙ্গে এর অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। ক্যারল ক্যুনিহান, কেন আলবালা, কৃষ্ণেন্দু রায়, লিজ়ি কলিংহ্যাম— তাবড় পণ্ডিতেরা লিখেছেন, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস কী ভাবে সমাজচিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। খাদ্য যে শুধু রসাস্বাদনের কথা বলে তা তো নয়, বৈষম্যের কথাও বলে, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতপাতের ভেদাভেদের কথাও বলে। কেবলমাত্র শর্করার আখ্যান যে সাম্রাজ্যবাদের বৃহৎ চিত্র আঁকতে পারে, সিডনি মিন্টজ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের।
ইতিহাসের আখ্যান, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, জনপ্রিয় ইতিহাস, খাদ্যচিত্রের আখ্যায়িকা, খাবারের ব্লগ— খাবারদাবার নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার কোনও শেষ নেই। সম্প্রতি হাতে এল এমন একটি বই যাকে হয়তো আমরা কোনও ভাবেই বিদ্যায়তনিক ইতিহাসের পরিসরে বাঁধতে পারব না। কিন্তু একই সঙ্গে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার ধারায়ও বইটিকে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। নীলাঞ্জন হাজরার খিচুড়ি বইটি আমাদের জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, চাল-ডাল মিশ্রিত এই খাদ্যের চমৎকার উপস্থাপনা। একটু ভুল হয়ে গেল বোধ হয়। লেখক আসলে দেখিয়েছেন, শুধু চাল-ডালের পরিমাপে খিচুড়িকে বোঝা একটি গর্হিত অপরাধ। ২৬৯ পৃষ্ঠার এই বইটি শুধু খিচুড়ি কবে এল, বা ভারতের কোন প্রদেশে কী ধরনের খিচুড়ি খাওয়া হয়, এই নিয়ে আলোচনা নয়। এতে যেমন রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে আদি-মধ্যযুগে প্রচলিত নিরামিষ খিচুড়ির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, তেমনই রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য বানানো ‘রাইস আ লা স্যোর নাইটিঙ্গল’, লেখকের তর্জমায় ‘ভগিনী নাইটিঙ্গলের তরিকার ভাত’।
খিচুড়ি
নীলাঞ্জন হাজরা
৪৭৫.০০
কেতাব-e
প্রতিটি পরিচ্ছেদেই তিনি শুনিয়েছেন নানান কিসিমের খিচুড়ির কিসসা। বইটি শুরু হয়েছে ‘খিচড়ি আকবরি’ বা আকবরের দরবারের খিচুড়ির বর্ণনা দিয়ে। এর হদিস লেখক পেয়েছেন আবুল ফজলের আকবরনামা-র অন্তর্গত তিন খণ্ডের আইন-ই-আকবরি’র প্রথম খণ্ডে ‘বাদশাহি হেঁশেল’ থেকে। লেখক আমাদের বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য এই নানান পদ্ধতির খিচুড়ি সেবন। তিনি কিন্তু তার জন্য শুধুমাত্র পদ্ধতি অনুধাবন করেননি। তাঁর গবেষণার প্রক্রিয়াটি অনবদ্য। তিনি জানিয়েছেন, ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫-এর মধ্যে মোগল দরবারে এগারো রকমের চাল আসত। লেখক তার মধ্যে সুখদাস চালের খোঁজ করতে গিয়ে সন্ধান পান আরাকোট অঞ্চলে প্রচলিত সুখদাস বিরিয়ানির। ‘খিচড়ি জাহাঙ্গিরি’-র কথা বলতে গিয়ে তিনি আমাদের শুনিয়েছেন জাহাঙ্গিরনামা-য় বর্ণিত, গুজরাতে জাহাঙ্গির-আস্বাদিত একটি নতুন পদের কথা। মির বকাওয়াল, বাদশার খাস বাবুর্চি তাঁকে রেঁধে খাইয়েছিলেন গুজরাতের প্রসিদ্ধ বাজরার খিচুড়ি, যা খেয়ে জাহাঁপনা যারপরনাই দিলখুশ।
খিচুড়ির কুলজি খুঁজতে লেখক অবাধে বিচরণ করেছেন কাশ্মীর থেকে ভারতবর্ষের দক্ষিণ উপদ্বীপ পর্যন্ত। কী না দেখেছেন তিনি— নাট্যশাস্ত্র, মনুস্মৃতি, মেধাতিতির ভাষ্য, বিনয়পিটক। লেখকের উদ্দেশ্য শুধু যে খিচুড়ির কালানুক্রমিক ইতিহাস লেখা তা-ই নয়, হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট উল্লেখ করে লেখক বলেন, “আজকের খিচুড়ির যে মৌলিক রূপ, চাল ও ডালের যুগলবন্দি, প্রণম্য হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় যে কৃসরাকে বলেছেন খিচুড়ির পূর্বজ, প্রাচীনকালে বিস্তীর্ণ সময় ধরে কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব, মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিপুল ভুখণ্ডে, ১০০ পূর্বসাধারণাব্দ থেকে ৯০০ সাধারণাব্দ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সময়কালে সেই কৃসর বা কৃসরা তা ছিল না। বরং বলা যেতে পারে তা ছিল চাল-তিলের যৌথ সংগীত, যাতে কখনো কখনো সঙ্গত করত দুধও।”
এই বিশদ আলোচনা লেখক করেছেন বিশেষ কারণে। ২০১৭-তে নাকি খিচুড়িকে ভারতের জাতীয় খাবার ভাবা যেতে পারে কি না তা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়। খিচুড়ির যে ছবি জনমানসে আঁকা হয় তা হল একটি শুদ্ধ নিরামিষ খাবার, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য। এই নতুন জাতীয়তাবাদের যে প্রতিচ্ছবি— লেখক তারই এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি এমন কোনও প্রমাণ পাননি যে, প্রাচীন ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা খিচুড়ি খেতেন। লেখক তাই তথ্য খোঁজেন অন্যত্র: বিনয়পিটকে, বৌদ্ধদের তেকাটুলায়াগু-তে, প্রাচীন সঙ্গম সাহিত্যে, কিন্তু খোঁজ মেলে না খিচুড়ির। শেষে সন্ধান মেলে ষোড়শ শতকে, ভাবমিশ্র রচিত আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ ভাবপ্রকাশনির্ঘণ্ট-তে। ইসলামি শাসনে প্রাচীন হিন্দু বিজ্ঞানশাস্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল, এই হিন্দুত্ববাদী প্রচারের গালে এই বইটি ‘বিরাশি সিক্কার চড়’, এমনই লেখকের মত।
খিচুড়ির কিসসায় যোগ হয়েছে ঔপনিবেশিক যুগে খিচুড়ি-প্রভাবিত, হ্যাডক মাছ মিশ্রিত কেজরি-র কথা। লেখকের ভ্রমণের নেশা তাঁকে পরিচয় করায় মিশরের চাল ডাল পাস্তা মিশ্রিত কোশরি-র সঙ্গে। অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, লেখকের নিজের টান বোধ হয় সবচেয়ে বেশি আদি-মধ্য ও মধ্যযুগের খিচুড়ির প্রতি। ‘অবধ ও নিজামশাহীর রোশনাই’ অধ্যায়ে লেখক যখন এগারো রকম মাংসের খিচুড়ির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান তখন বোঝা যায়, আজকে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের জয়জয়কারের আস্ফালনের সময় বইটির প্রয়োজনীয়তা কতখানি। তিনি বার বার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, খাঁটি/প্রকৃত (অথেন্টিক) খাবার নিয়ে এই যে উন্মাদনা, তার আড়ালে বাঙালি হেঁশেলের সংশ্লেষের ধারণাটি হারিয়ে গেছে। এই বইটি যে কোনও খাদ্য ইতিহাসের গবেষকের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি এই জন্যও কারণ রসসমৃদ্ধ ইতিহাস রচনাও আমাদের একটি দায়। লেখকের কথাতেই— “ইতিহাস আর দাস্তান কেমন চালে-ডালে একাকার। এখানেই তো এ বিচিত্র ভূখণ্ডের, ইতিহাসচর্চার একাধারে চ্যালেঞ্জ ও শিহরন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy