চিরন্তন: রাঁচীতে সাঁওতাল নাচ। ষাটের দশকের ছবি
‘আদিবাসী’ জনজীবনের ইতিহাস অনুসন্ধানের ধারাটি যথেষ্ট পুরনো। বিগত শতকের আশির দশকে ডেভিড হার্ডিম্যানই সম্ভবত প্রথম ‘আদিবাসী’ শব্দটির ইতিহাসবাহিত বহুমুখী ব্যঞ্জনা উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হন। তিনি লক্ষ করেন, ইতিহাসের রাজপথে বন্ধন-অসহিষ্ণু এই পদাতিক গোষ্ঠী উনিশ শতকে কী ভাবে বাঁধা পড়ে ঔপনিবেশিক প্রতিবন্ধকতার কঠিন নিগড়ে, কেন শুরু হয় ‘বহিরাগত’দের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় যৌথ প্রতিরোধ আন্দোলন। ভার্জিনিয়াস খাখা দেখান, নবাঙ্কুর ‘আদিবাসী চৈতন্য’-এর প্রভাবে কী ভাবে আদিবাসীরা বুঝতে পারেন তাঁদেরই জল, জমি, জঙ্গল থেকে উৎখাত হয়ে নিজভূমে তাঁরা পরবাসী! অমিতা বাভিস্কার ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে স্থাপন করেন উদারীকৃত পলিটিক্যাল ইকনমির সঙ্গে ও প্রসঙ্গে, আর লক্ষ করেন যে, কী ভাবে তাঁরা একটি প্রান্তিকায়িত নতুন শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। ক্রিস্পিন বেটস ও আলফা শাহ আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্ব দিয়ে দেখান, কখন ও কী ভাবে এক বিশেষ ধরনের প্রতিরোধ, ‘আদিবাসী আন্দোলন’-এর ধারণায় আধারিত হচ্ছে। ড্যানিয়েল রাইক্রফ্ট ও সঙ্গীতা দাশগুপ্ত ‘আদিবাসী হয়ে ওঠা’র পিছনে সক্রিয় রাজনীতিকে চিহ্নিত করার উপর জোর দেন, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে কী ভাবে নানা ঘটনা, ক্রম, স্থান ও কল্পমূর্তির ভিতর দিয়ে ‘আদিবাসী’ নির্মিত হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, ‘আদিবাসী’ ধারণার এই সুদীর্ঘ, সদা-বিবর্তিত ধারায় নির্মলকুমার মাহাতো কী নতুন মাত্রা যোগ করলেন? দু’টি বিষয় এই গ্রন্থটিকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে। এক, ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য লেখক আদিবাসী গ্রামে যাননি, কেননা তিনি নিজেই আদিবাসী গ্রামের আদি নিবাসী। আর সেই কারণেই তিনি নিজেই তাঁর ন্যারেটিভের অন্তর্গত হয়ে আছেন। দুই, তাঁর লক্ষ্য এমন এক আদিবাসী সমাজের আখ্যান রচনা করা, যেখানে জীবজগতের অন্য সব প্রাণী ও বৃক্ষ-লতা-গুল্মকে নগণ্য আর মানুষকেই অগ্রগণ্য ভাবা হয়নি। তাঁর জোর প্রকৃতিলগ্ন আদিবাসীদের মূল্যবোধ, আত্মপরিচয় আর যাপিত জীবনলব্ধ জ্ঞানবিধির মূল্যায়নের উপর। তিনি মনে করেন, এগুলির ক্ষয়িষ্ণুতার বেদনা থেকেই অরণ্যচারী আদিবাসী মানুষের রোদনভরা জীবনসঙ্গীত রচিত হয়েছে।
পাঁচটি অধ্যায়ে লেখক তাঁর বক্তব্য মেলে ধরেছেন। প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রাক্-ঔপনিবেশিক মানভূমের বাস্তুসংস্থান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিচয় দেন। গভীর জঙ্গলে আচ্ছাদিত মানভূমের মাটি পর্যাপ্ত কৃষিকর্মের উপযুক্ত ছিল না। জনজাতি, আধা-জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত অরণ্যসম্পদ থেকেই আহরণ করতেন জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। মানভূম ছিল আদর্শ ‘আদিবাসী ভূমি’।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসীদের সহবাসের নিয়ম তুলে ধরেছেন। অধিকাংশ গবেষণায় আমরা দেখি মানুষের উপর প্রকৃতির প্রভাব, কিংবা প্রকৃতি কী ভাবে মানবজীবনকে প্রভাবিত করেছে তার আলোচনা। অর্থাৎ, এ-যাবৎ মানুষকেই মুখ্য চালক-চরিত্র হিসাবে ভাবা হয়েছে। লেখক এই গুরুত্বের তারতম্য মুছে দিয়েছেন। তিনি লক্ষ করেন, আদিবাসীরা কী ভাবে মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিকতার আখ্যান গড়ে তুলেছিলেন। জল কী ভাবে সেচ ও ‘রাষ্ট্রগঠন’-এর সহায়ক উপাদান হয়ে উঠল, ‘বাঁধ’ বা পুষ্করিণী কী ভাবে আদিবাসী অস্তিত্বকে বাঙ্ময় করে তুলেছিল, আদিবাসীদের নৈতিকতা কেন জলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। পাশাপাশি লেখক দেখান, গাছগাছালির ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে আদিবাসীদের সঞ্চিত জ্ঞান, শরীর নিয়ে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা, রোগের নিদান, চিকিৎসাবিধি, ঔষধি আহরণ, ঔষধ প্রস্তুতি ও সংরক্ষণ পদ্ধতি।
সরো সংগ অব উডস: আদিবাসী নেচার রিলেশনশিপ
নির্মল কুমার মাহাতো
৯৯৫.০০
প্রাইমাস বুকস
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক লক্ষ করেন, কী ভাবে ব্রিটিশ সরকার সেই অরণ্য সুনিবিড় ভূগোলে একটি কেজো ‘আদিবাসী ক্ষেত্র’ নির্মাণ করল। ফলত আদিবাসীদের বন্য ভূদৃশ্যের সংজ্ঞা বদলে যায়। বদলে যায় অরণ্য, কৃষিখামার আর তৃণভূমির সাবেক চরিত্র। ‘পশুভূমি’ নামে পরিচিত মানভূম, সিংভূম আর ধলভূম হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের মুনাফা শিকারের মৃগয়াক্ষেত্র। আদিবাসীদের জল-সর্বস্ব জীবনশৈলীকে ঔপনিবেশিক সরকার পুরোপুরি মুছে দেয়। ভূমি আর অরণ্যকে গড়ে তোলে উৎপাদন-সর্বস্ব একটি প্রকল্প হিসাবে। ফলত শুরু হল নির্বিচার অরণ্য নিধন। অরণ্য এখন ঢের বেশি জরুরি জাহাজ নির্মাণ আর রেলের স্লিপার বানানোর কাজে। এতে শুধু অরণ্যের ক্ষতি হল না, আমূল ব্যাহত হল আদিবাসী সমাজজীবন।
পরবর্তী অধ্যায়ে লেখক অরণ্যপ্রকৃতি আর আদিবাসী সমাজের এই সমূহ বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, প্রাক্-ঔপনিবেশিক আমলে সমভূমি আর অরণ্যভূমির মানুষের মধ্যে একটি বিনিময়-নিবিড় সুসম্পর্ক ছিল। অর্থনীতির সূত্র মেনে অরণ্যের উদ্বৃত্ত যেত সমভূমির মানুষের কাছে। বিনিময়ে সমভূমির মানুষ তাঁদের উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতেন অরণ্যবাসীদের নিত্যপ্রয়োজনে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আর জমিদারের লোভ ও লাভের টানে স্বাভাবিক জীবনরেখার এই জরুরি সূত্রটি ছিন্ন হয়ে গেল। আদিবাসীদের ‘পবিত্র উপবন’ (সেক্রেড গ্রোভ), পবিত্র জলাধার ও অরণ্যের অধিকার নষ্ট হল। ঋণ-বন্ধন, অনটন আর দুর্ভিক্ষ এখন তাঁদের নিত্য সহচর।
পরিশেষে লেখক আদিবাসীদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে দেখেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এ-যাবৎ অনেকেই আদিবাসী আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের অংশ বলেই সাব্যস্ত করেছেন। নির্মল বলেন, আন্দোলনের উৎসমুখ অন্যত্রও ছিল। আদিবাসী মধ্যবিত্তরা অতীত পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেন আদিবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতির পুনর্বাসনের মাধ্যমে। শুধু জমি নয়, অরণ্যসম্পদ ও মাদক তৈরির অধিকারও এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশেও যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে পারে, জাতি ও আত্মপরিচয় নিয়ে গবেষণারত উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা তা নিয়ে নিশ্চিত নন। জনজাতিরা রাষ্ট্রহীন, এই ধারণার বিরোধিতা করে লেখক বলেন, মানভূমের আদিবাসীরা উপযুক্ত জল-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে রাষ্ট্রগঠনের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন।
লেখক ‘ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজ়ম’-কথা বলেন, যার প্রেরণায় আদিবাসীরা জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার ভোগ করে আসছিলেন। লেখক জোর দেন জলসেবিত গ্রামসমষ্টির ধারণায়। জলের অধিকার হস্তান্তরিত হওয়ায় আদিবাসীরা ‘ইকোলজিক্যাল রিফিউজি’-তে পরিণত হলেন। লেখক কয়েকটি সাধারণ ভ্রান্তি সংশোধন করে বলেন, আদিবাসী সমাজও কর্তৃত্বের ক্রম অনুসারে বিন্যস্ত ছিল, ছিল অধিকার ভোগেরও অসমতা। রাজতন্ত্র, জল-জমি-জঙ্গলের রাজনীতি, প্রতিবেশী/প্রতিযোগী গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পেশাগত বিশেষীকরণ, বাণিজ্য কিংবা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আদিবাসী রাষ্ট্রভাবনা প্রকাশ পেয়েছিল।
লেখকের প্রকৃতিলগ্ন আদিবাসী জগতের ক্যানভাসটি বেশ বড়। তাই তাঁর ‘আর্কাইভ’ও বিচিত্রধর্মী। মানবাজার জমিদারি পেপারস, আঞ্চলিক মুক্তি পত্রিকা, বংশলতিকা, কুলজি, কথাকণিকা, আদিবাসী সাহিত্য, ট্যাটু, আদিবাসী চিত্রকলা, লোককথা, কিংবদন্তি, পারিবারিক স্মৃতি, মৌখিক বিবরণকে তিনি টেক্সট হিসাবেই পাঠ করেছেন।
একটি ব্যাপারে কিছুটা অস্বস্তি রয়ে গেল। লেখকের আলোচনার কুশীলব সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ, ভূমিজ, কোরা, কুর্মি, খেড়িয়া এবং বিরহোড় গোষ্ঠী। মূলত আদিবাসী হলেও এঁদের সকলেরই প্রকৃতির সঙ্গে বসবাসের নিয়ম, ধরন এবং শরীর ও স্বাস্থ্যভাবনা একমাত্রিক নয়। তাই বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীকে একই ছাতার তলায় নিয়ে এসে আলোচনা করাটা ইতিহাসবিদের পর্যবেক্ষণ-বিধি লঙ্ঘন করে। এঁদের স্বতন্ত্রতা, বিভিন্নতা, সম্মতি ও বিরোধ সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে নির্মেদ কথন-কৌশলের নৈপুণ্যে গ্রন্থটি সুখপাঠ্য। কথায় কথায় ফুটনোটের নিশান পুঁতে রেখে সাধারণ পাঠককে লেখক বিড়ম্বিত করেননি। বিশ্লেষণের প্রমিত কৌশল ও যথার্থতায় গ্রন্থটি মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির এক সাংস্কৃতিক জীবনী হয়ে উঠেছে।
অরবিন্দ সামন্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy