রচনাসমগ্র: তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
সম্পাদনা: পুলক চন্দ
৬৯৯.০০ ও ৭৫০.০০
দে’জ পাবলিশিং
১৯২০ সালের ৫ জুন ইংল্যান্ড পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ। কেনসিংটন প্যালেস ম্যানসনে তিনি সে-বার উঠেছিলেন, ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ও তখন লন্ডনে। তিনিও এই ম্যানসনের কাছাকাছি থাকেন। এক দিন ক্লান্ত তপনমোহন রাত বারোটায় রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন, হঠাৎ একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল প্যালেস ম্যানসনের সামনে। তিনি দেখলেন, স্বয়ং গুরুদেব গাড়ি থেকে নেমে তাঁর ‘ঝোলা জোব্বার’ এ-পকেট ও-পকেট হাতড়াচ্ছেন কিন্তু ট্যাক্সিভাড়া মেটানোর টাকা খুঁজে পাচ্ছেন না। তপনমোহন কাছে যেতেই বললেন, “এই, তোর পকেটে কিছু আছে নাকি? না, আমারই মতন একেবারে শূন্য?” তপনমোহনের কাছে ছিল, টাকা মিটিয়ে দেওয়া গেল। গুরুদেব নিশ্চিন্ত হলেন।
তপনমোহন এক দিন কবি ইয়েটসের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঘরে ঢোকার পর তাঁর তাক লেগে গেল। ঘরের দেওয়ালের রং কালো, যাবতীয় জিনিসপত্র মায় ফ্লোরজোড়া কার্পেট, টেবিল, চৌকি, সোফা, কৌচ, ক্যাবিনেট এমনকি জানালার পর্দাও কালো। ঘরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে না, ব্রোঞ্জের বাতিদানে দুটো করে মোমবাতি। ঘরে এসে ঢুকলেন লম্বা-চওড়া সুপুরুষ কবি, পরনে কালো স্যুট। সৌম্যদর্শন পুরুষটির চুলও বেশ লম্বা, কানের উপর এসে পড়েছে। কিছু ক্ষণ পরে চায়ের সরঞ্জাম এল— “অবাক কাণ্ড! পেয়ালা পিরিচ চা-দানি দুধ-দানি এমনকি কোয়ার্টার প্লেট ইস্তক সবই যে কালো রঙের!” ঘরের বাইরে বারান্দায় ক্যানবেরি খাঁচাকে লক্ষ্য করে থাবা পেতে বসে আছে এক কালো কুচকুচে বিড়াল। তার চোখ দু’টি শুধু সবুজ বাল্বের মতো জ্বলছে।
কিন্তু কেন এই কালো-প্রীতি? নোবেল পুরস্কার-প্রাপ্ত ইয়েটসের ছিল অতীন্দ্রিয়বাদ বা অকাল্টিজ়মের প্রতি গভীর আগ্রহ, তিনি ‘ঘোস্ট রাইটিং’-এর চর্চা করতেন, তাই গৃহসজ্জাতেও ছিল তার সুস্পষ্ট ছাপ। স্বল্প ক্ষণের বৈঠকে ইয়েটস তাঁকে শুনিয়েছিলেন এক পরিচিত হিন্দু ব্রাহ্মণের গল্প— সেই ব্রাহ্মণটি ছিলেন তপনমোহনের পিতা মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। দেশে ফিরে আসার পর তপনমোহন ইয়েটসের পাঠানো একটি খামে ভরা ইংরেজি কবিতা পেয়েছিলেন। কবিতার শিরোনাম ‘Mohini Chatterjee’।
এ রকম অজস্র চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণময় গল্প-কাহিনি পাওয়া যায় তপনমোহনের স্মৃতিরঙ্গ বইটিতে। এক সময়ে শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে পাওয়া যেত এই বই, যেমনটি যেত তাঁর লেখা পলাশির যুদ্ধ, পলাশির পর বক্সার, মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড ইত্যাদি বই। ইদানীং তপনমোহনকে নিয়ে তেমন চর্চা আর দেখা যায় না। অথচ পেশায় ব্যারিস্টার হলেও তাঁর ইতিহাসচর্চা, সাহিত্যচর্চা, পুঁথিচর্চা আর সরস গল্প বলার ক্ষমতা ছিল অতিশয় সমৃদ্ধ। পলাশির যুদ্ধ পড়ে সুশোভন সরকার লিখেছিলেন, “ঝরঝরে ভাষা, তরতরে লেখা... গল্পের মতন চিত্তাকর্ষক... আগাগোড়া স্বচ্ছন্দ, সরল, সাবলীল গতি। বাংলা ইতিহাস রচনায় ঠিক এমন স্টাইল চোখে পড়া দুর্লভ।” স্মৃতিরঙ্গ পড়ে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য, তাঁর “লেখার হাত ছিল ছিপছিপে, কথাগুলো তরতর করে বয়ে চলে।”... আর “বিষয়ের সীমানা তিনি জানেন, থামতে পারেন সময় মতো।”
এমন যে সুলেখক, ইতিহাসবিদ, আইনজ্ঞ তপনমোহন তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা কিন্তু নিতান্ত সীমিত। তবে ইতস্তত ছড়ানো নানা জাতের অগ্রন্থিত টুকরো লেখার পরিমাণ প্রচুর। আর রয়েছে তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অমল হোম, অন্নদাশঙ্কর রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আঁদ্রে কার্পেলে, লেনার্দ এল্মহার্স্ট, সুধীরঞ্জন দাস প্রমুখের বেশ কিছু চিঠি। আর বিশ্বভারতীর অধ্যাপক, বাংলা পুঁথির সম্পাদক, অবেক্ষক ও কিংবদন্তিতুল্য গবেষক পঞ্চানন মণ্ডলকে লেখা তপনমোহনের ১০৭টি পুঁথি বিষয়ক চিঠি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।
স্নেহাস্পদ পঞ্চাননকে লেখা চিঠিগুলি পড়লে বোঝা যায়, তপনমোহনের পুঁথিচর্চা ও সংরক্ষণ বিষয়ে কতখানি জ্ঞান আর উৎসাহ ছিল, পঞ্চানন মণ্ডলকে কী ভাবে তিনি সাহায্য করতেন। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের পুঁথি সংরক্ষণ বিষয়ে শৈথিল্যের কথাও এ সব চিঠিতে ধরা পড়বে।
ছাত্রাবস্থায় ১৯১১ সালে তপনমোহনের প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘মহাত্মা খৃষ্টের একটি উপদেশ’, প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী পত্রিকায়। আর জীবনের শেষ পর্বে লিখেছিলেন যীশুচরিত নামে পূর্ণাঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। কিন্তু এই বই তপনমোহনের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮) পঁচিশ বছর পর ১৯৯৩ সালে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করেছিল এই গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার ব্যাপারে তপনমোহনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। কারণ, প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের অনুকূলে ছিল না এই রচনা। কিন্তু বন্ধু এল্মহার্স্ট চিঠিতে জানাচ্ছেন তপনমোহনকে: “... অতীতের মিশনারিদের প্রচার করা ধর্মের লৌহকঠিন ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী নন, এমন বহু মানুষ আপনার বইয়ে আগ্রহী হবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস... দেরি করবেন না, এই বইকে দেরাজে তালাবন্দি করে রেখেও দেবেন না...।” এল্মহার্স্ট এই অনুরোধ জানাচ্ছেন ২৪ জানুয়ারি। তার বারো দিন পরেই তপনমোহন চলে গেলেন।
১৯১৪ সালে ভারতী পত্রিকায় তপনমোহন একটি গল্পও লিখেছিলেন (‘মৃত্যু-স্বয়ম্বরা’), ১৯১৫-তে লিখেছিলেন খেলা নামে এক পূর্ণাঙ্গ নাটক, যেটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। একই সময়ে লিখেছিলেন একটি নাটিকাও। আর সারা জীবনে তাঁর অগ্রন্থিত রসসমৃদ্ধ প্রবন্ধের সংখ্যা সাতাশটি। ইতিহাসের গ্রন্থ ছাড়া লিখেছেন বাংলা লিরিকের গোড়ার কথা-র মতো সাহিত্যমূলক গ্রন্থ। লিখেছেন আইনজ্ঞের দৃষ্টিতে হিন্দু আইনে বিবাহ-র মতো প্রাঞ্জল ঐতিহাসিক বই।
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের এই রচনাসমূহ দু’টি বৃহৎ খণ্ডে সটীক সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেছেন এ কালের বিশিষ্ট গবেষক-সম্পাদক পুলক চন্দ। সম্পাদনা কর্মে সুগভীর নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের কারণে বিদ্বজ্জনমহলে পুলক বিশেষ আদৃত ও পরিচিত। স্বাভাবিক কারণেই তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সমগ্র রচনা পাঠকের সামনে হাজির করে পুলক আরও একটি সংবর্ধনাযোগ্য কাজ করলেন। শুধু তপনমোহনের রচনা নয়, তাঁর প্রতিটি বই ও টুকরো অগ্রন্থিত প্রবন্ধগুলি বিষয়ে বিস্তৃত টীকা ও অজানা তথ্য সংগ্রহ করে তপনমোহন বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি হাজির করেছেন পুলক, যা বাঙালি পাঠককে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে। প্রসঙ্গত এ কথাটিরও উল্লেখ প্রয়োজন যে, রাজা রামমোহন রায়ের প্রদৌহিত্র মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরোজসুন্দরীর কনিষ্ঠ পুত্র হলেন তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়। পিতা মোহিনীমোহন ছিলেন ইয়েটসের শ্রদ্ধেয় বন্ধু, এবং প্রেতচর্চা সূত্রেই তাঁদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক। এই সব ঘটনার বিস্তৃত তথ্য এবং তার সঙ্গে আরও এক বিশেষ ঘটনার কথা বলেছেন পুলক। ১৮৯২ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধটি পড়ে মোহিনীমোহন কবির সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। মোহিনীমোহনের সেই রচনাটি বিশেষ পরিচিত নয়। মোহিনীমোহনের সেই রচনাটিরও বিস্তৃত পাঠ এখানে মুদ্রিত হয়েছে। সঙ্গে তাঁর আরও কিছু রচনা পুলক চন্দ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাঠকের কাছে অবশ্যই সে সব এক চমৎকার উপরি পাওনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy