Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Book Review

শুধু মানব-ই থেকে যায়...

দেশভাগ ও তার বহমান প্রতিক্রিয়া অমর মিত্রের প্রিয় বিষয়। ছিটমহলের বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা নিয়ে লেখা তাঁর কুমারী মেঘের দেশ চাই পাঠককে মুগ্ধ করেছিল।

জীবনযাত্রা: হরিদাসপুরে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। আশির দশকের ছবি

জীবনযাত্রা: হরিদাসপুরে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। আশির দশকের ছবি

গোপা দত্ত ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৯
Share: Save:

দেশভাগকে এক প্রবহমান যন্ত্রণার আলেখ্য রূপে উপস্থিত করেছেন অমর মিত্র তাঁর এই উপন্যাসে। সিরিল র‌্যাডক্লিফ নাকি সবিনয় জানিয়েছিলেন, ভারতের মানচিত্রে দ্রুতগতিতে কাঁচি চালানোর যোগ্য দক্ষতা তাঁর নেই। তবে তাঁর উপর অসাধ্যসাধনের চাপ ছিল। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, স্মৃতির সরণির উপর হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিনিময়ের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর নির্মম করাত নেমে এল। অবশ্য তার আগেও ছিল আত্মঘাতী ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট। গড়িয়ার আতিকুজ্জামান ও সাতক্ষীরার সদাশিব চন্দ্রের পরিবার দু’টিকে কেন্দ্রে রেখে কুহক বাস্তবের মায়াবুনট তৈরি করেন ঔপন্যাসিক। পরিবার দু’টি ভূসম্পত্তি ‘এক্সচেঞ্জ’ করেছিল। আতিকুজ্জামানের হারানো মেয়ে আঁখিতারার নামাঙ্কিত ‘আঁখিমঞ্জিল’ যেন ভারতের যন্ত্রণাকাতর সত্তার প্রতীকী রূপ পায়।

দেশভাগ ও তার বহমান প্রতিক্রিয়া অমর মিত্রের প্রিয় বিষয়। ছিটমহলের বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা নিয়ে লেখা তাঁর কুমারী মেঘের দেশ চাই পাঠককে মুগ্ধ করেছিল। এই উপন্যাসেও পারিবারিক কাহনকে তিনি ইতিহাসের বৃহত্তর সঙ্কটের সঙ্গে অসামান্য নৈপুণ্যে যুক্ত করে দেন। উপন্যাসের সূচনাতে আছে ভবিষ্যতের ইশারা দেওয়া একটি ঘটনা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে মুসলিম লিগের প্রাদেশিক কাউন্সিলের সভায় বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে কৃষকরা ছুটে আসছেন দলে দলে। সে কি আপাদমস্তক সাহেব মহম্মদ আলি জিন্নাকে দেখতে, না আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে তাঁদের প্রাণের গান শুনতে? জিন্না বললেন, গান হবে না। “হাজার হাজার হেলে চাষা, মুখ্যু চাষা, লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা চাষার দল বলে উঠল, গান ছাড়া সভা হবে না।” সেই দাবির কাছে নতি স্বীকার করলেন উর্দু ভাষার পক্ষে প্রধান সওয়ালকারী জিন্নাসাহেব।

এই ছোট্ট ঘটনাটির মধ্যে যেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের জন্মকথা লুকিয়ে ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের গোড়াতেই যে গলদ ছিল। এই উপন্যাসে ফিরে ফিরে এসেছেন গান্ধী, জিন্না, নেহরু, পটেল, সুভাষ, চিত্তরঞ্জন, যোগেন মণ্ডল, কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র রক্তাক্ত বীভৎসতা। দেশকে অখণ্ড রাখার প্রচেষ্টা কী ভাবে সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হল সেই ইতিকথা। আতিকুজ্জামানের বড় ছেলে রব মুসলিম লিগের কট্টর সমর্থক, সে বলত, “জিন্না পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন মুসলমানের জন্য, যেতে হবেই। আসলি পাকিস্তান তো পশ্চিম, করাচি, লাহোর। পুবের পাকিস্তানকে পশ্চিমের মতো গড়ে তুলতে হবে।” রব খুব উর্দু বলে। বলতে চায়। বলে, মুসলমানের জবান বাংলা নয়, কায়েদ-ই-আজ়ম তাই বলেছেন।

রব আর তার উত্তর ভারতীয় বন্ধু শহিদুল আতিকুজ্জামানের ভূসম্পত্তির ভাগীদার কমানোর জন্য রবের সৎ বোন, বালিকা আঁখিতারাকে দমবন্ধ করে খুন করে দিঘির জলে ফেলে দিয়েছিল। দেশভাগের ডামাডোলে তাদের এই জঘন্য অপরাধ চাপা পড়ে যায়। পরে রব প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে, পরে বাংলাদেশে নামকরা লোক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দুর সম্পত্তি ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নিয়ে বিস্তর সম্পত্তি করে সে। রবের আলিশান হাভেলি, লম্বা রাজহাঁসের মতো বিদেশি গাড়ি, দু’বার সাংসদ হয়েছে সে। দু’বার হজ করে হাজি। ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত— কোথাও পাপের দাগ লেগে নেই যেন। নিজের সহোদর ভাই রহিমকেও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রাণের ভয় দেখায় রব। শান্ত, ধীরবুদ্ধি রহিম পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে ফিরে আসে পশ্চিমবঙ্গে— বংশানুক্রমে দরিদ্র তারা। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিবাকরি পায় না রহিমের ছেলে বা নাতি।

র‌্যাডক্লিফ লাইন

অমর মিত্র

৪৯৯.০০

দে’জ়

কী অভিশপ্ত মনে হয় এই উপমহাদেশকে— অন্যায়কারী জিতে যায়, জিততেই থাকে। প্রেতিনী আঁখিতারা সাক্ষী হয়ে থাকে এই মর্মান্তিক ইতিহাসের। বরিশাল থেকে উচ্ছিন্ন দুঃখী জীবনানন্দ দাশ আছেন এই উপন্যাসে— নদীমাতৃক সেই জলজ নিবিড় প্রকৃতি থেকে চিরকালের জন্য ছিন্ন হওয়ার বেদনাই কি তাঁকে ঠেলে দিল ট্রামের ক্যাচারের সামনে? মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এক অনুরাগী পাঠককে লিখেছিলেন, তাঁর খুব বরিশাল যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পাসপোর্ট করে ভিসা নিয়ে বরিশাল যাওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। আমাদের মনে পড়ে যায়, জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের নায়করা কলকাতার দমবন্ধ বিবর্ণতা থেকে কী ভাবে বার বার ফিরতে চেয়েছে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতির সজল সান্নিধ্যে।

আঁখিমঞ্জিল দাঁড়িয়ে আছে প্রোমোটারের থাবার সামনে। নানা সময়ের স্রোতের মধ্যে করোনাকালীন সাম্প্রতিক কালবৃত্তটি রয়েছে। সদাশিব চন্দ্রের ছোট ছেলে কমল প্রবল হিন্দুত্ববাদী। মুসলমানের চিহ্ন-লাগা বাড়ি সে ভেঙে ফেলতে চায়। প্রোমোটার অখিল ‘নিরামিষ হাইরাইজ়’ বানাবে। “ইন্ডিয়া এখন নিরামিষ খায়। এর পরে আইন হয়ে যাবে। নিরামিষাশী লোকের চাকরি হবে আগে। ব্যাঙ্ক লোন পাবে আগে।” কমল বলে, “হিন্দু তার হক বুঝে নেবে এ বার।... মুসলমানের ছোঁয়া সব গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে।... যত মুচি, মেথরকে হিন্দুধর্ম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম তারা হল মুসলমান। তাদের আবার তাড়াতে হবে, তাদের স্পর্শ অপবিত্র।”

এমনই একটি ‘নিরামিষ আবাসনে’ এনআরআই সুচরিতার সহকারিণী হয়ে আছে বনদেবী— আসলে বনবিবি— ‘নিরামিষ আবাসন’-এ মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ তাই নাম বদল। আঁখিতারার সমান্তরালে বনদেবীকে নিয়ে বইয়ে কুহক বাস্তবের আর একটি মায়ালোক সৃষ্টি করেছেন ঔপন্যাসিক। বনবিবির পালার বিবির ভাই জংলি শাহ ফিরে আসে এই উপন্যাসে। “খাটতি গিছিল পশ্চিম-উত্তরে, ফিরেনি। শুনেছি তারে পিটানি দিয়ে মেরেছিল। তার ব্যাগে নাকি গোস্ত ছিল।” গণপিটুনিতে নিহত নিরপরাধ আখলাকের মুখ ভেসে ওঠে পাঠকের মনে। ধর্মান্ধতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে তিন টুকরো হওয়া উপমহাদেশ— আমাদের কি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই! সুচরিতার ধর্মধ্বজী আবাসনে প্যানডেমিক তাড়াতে করোনাদেবীর উপাসনার ব্যবস্থা করেছে কমিটির পান্ডারা। কোনও ভ্যাকসিন নয়— ধর্মই বাঁচাবে যেন তাঁদের।

গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে করোনাকাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ওঠাপড়াকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে বাস্তব আর কুহক বাস্তবের টানাপড়েনে বুনেছেন লেখক। ইতিহাসের মানুষ আর কল্পনার মানুষ মিলেমিশে এই উপন্যাসের বিস্তৃত ক্যানভাস। হিন্দু আর মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের স্বার্থপর সহিংস নির্বুদ্ধিতা শুধু নয়, নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষের জীবনধারণায় মুক্তির দিশা রেখেছেন তিনি। মানুষ মানুষই শুধু— যতই তাকে ভেদচিহ্নের তিলক বা টুপি পরানো হোক না কেন। শেষ পর্যন্ত শুধু মানবই থেকে যায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন করে কায়েদ-ই-আজ়মের বন্দনার পর, ২০২৩ সালে লেখা এই উপন্যাসের চেতাবনি আরও প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy