—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ভারতে চল্লিশের দশকে ৯২ শতাংশ হাসপাতাল ছিল সরকারি। আর আজ? ২০২০-র এক সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতের উনিশ লক্ষ হাসপাতাল-শয্যার প্রায় বারো লক্ষ বেসরকারি হাসপাতালে; আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরও বেসরকারি ক্ষেত্রেই বেশি। এই বিবর্তন প্রতিফলিত কলকাতার হাসপাতাল-চিত্রেও। ষাটের দশকে বেসরকারি চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয় ছোট নার্সিং হোম, ক্লিনিক দিয়ে, শয্যা-সংখ্যার নিরিখে যা ছিল নগণ্য। আশির দশক থেকে চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবেশ করে বড় বড় কর্পোরেট ব্র্যান্ড। অতঃপর ক্রমাগত বেড়েছে বৃহৎ পুঁজির লগ্নি: সম্প্রতি মণিপাল গ্রুপ মেডিকা ও তিনটি ‘আমরি’ হাসপাতাল অধিগ্রহণ করেছে, অ্যাপোলো নতুন একটি হাসপাতাল কিনেছে, নারায়ণ হেলথ গ্রুপ হাজার শয্যার নতুন হাসপাতাল তৈরি করছে নিউ টাউনে। কলকাতার ‘কর্পোরেট হাসপাতাল’-শয্যার অর্ধেকই এখন দক্ষিণ ভারতের তিন ব্র্যান্ডেড হাসপাতালের অধীনে। বিত্তবানের জন্য বেল ভিউ, উডল্যান্ডস দিয়ে বেসরকারি চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালের দরজা খুলে গেছে ‘বিপিএল’ মানুষের জন্য, সরকারি স্বাস্থ্যবিমার সৌজন্যে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির অবস্থান, সরকারি নীতির পরিবর্তন ও ব্যবসায় বিনিয়োগের নকশা, এ সবই ক্রমাগত বদলে গিয়েছে বলে ভারতে তথা কলকাতায় চিকিৎসার ছবিও বদলেছে।
হেলথকেয়ার ইন পোস্ট-ইন্ডিপেন্ডেন্স ইন্ডিয়া: কলকাতা অ্যান্ড দ্য ক্রাইসিস অব প্রাইভেট হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস
অমৃতা বাগচি
১৪৯৫.০০
রাটলেজ
পরিবর্তনের সেই পথটি চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অমৃতা বাগচি। কলকাতা তথা বাংলায় চিকিৎসার ইতিহাস চর্চার আগ্রহ কম নয়। তবে যত লেখালিখি পাওয়া যায় ব্রিটিশ আমলে জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থা, মেডিক্যাল কলেজগুলির ও মেডিক্যাল গবেষণার ইতিহাস নিয়ে, বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে অত চোখে পড়ে না। এ নিয়ে তথ্য-পরিসংখ্যানও সুলভ নয়। ষাট-সত্তরের দশকে কলকাতায় কত নার্সিং হোম ছিল তার প্রামাণ্য নথি নেই, অমৃতা নির্ভর করেছেন পত্রপত্রিকার প্রবন্ধের উপরে। তাঁর আন্দাজ, সে সময়ে কলকাতায় নার্সিং হোমের সংখ্যা ছিল চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে। অধিকাংশই ছিল প্রসূতিসদন— মধ্যবিত্ত, কর্মরত মেয়েরা সরকারি হাসপাতাল এড়াতে চাইতেন। অনেক চিকিৎসক নিজেদের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের লেজুড় হিসেবে আট-দশ বেডের নার্সিং হোম তৈরি করেছিলেন। বিভিন্ন দশকে তৈরি নার্সিং হোমগুলির কর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে অমৃতা দেখিয়েছেন, উচ্চপ্রযুক্তির চিকিৎসা পড়তায় পোষায় না বলে অধিকাংশ নার্সিং হোম উঠে গিয়েছে। বাকিরা টিকে রয়েছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ধাঁচে।
চিকিৎসকের বিনিয়োগ থেকে আন্তর্জাতিক বৃহৎ লগ্নিকারী সংস্থার বিনিয়োগ— এই বিবর্তন কী করে ঘটল, তার নিবিড় ছবি এঁকেছেন অমৃতা। দেখিয়েছেন, আশির দশকেও বেসরকারি ক্ষেত্রকে সরকারি ব্যবস্থার সহায়ক (সাপ্লিমেন্টারি) বলেই মনে করা হত। নব্বইয়ের দশক থেকে বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহ দিতে শুরু করে সরকার— দামি যন্ত্রপাতির শুল্ক কমিয়ে, কম দামে জমি দিয়ে। পাশাপাশি সরকারি স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ কমতে থাকে। নতুন শতকে স্বাস্থ্য বাজেটের একটা বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় স্বাস্থ্যবিমায়, যার অধিকাংশই এখন যায় বেসরকারি হাসপাতালের থলেতে। ভারতে এই ধারাগুলির পিছনে কী ভাবে কাজ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও আমেরিকার নানা অসরকারি সংস্থার নীতি, তা-ও দেখিয়েছেন লেখিকা। চিকিৎসার ইতিহাসের নিরিখে বইটি অপরিহার্য তো বটেই, কলকাতার অতীত-চর্চার জন্যও মূল্যবান।
নজরে
বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স বা আচরণ-ভিত্তিক অর্থনীতির অগ্রণী তাত্ত্বিক, নাজ নামক বিশ্ববন্দিত গ্রন্থের অন্যতম লেখক ক্যাস সানস্টেন স্বনামধন্য। এ বইয়ে তাঁর সহ-লেখক ট্যালি শ্যারটও নিউরোসায়েন্সের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ এবং একাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের লেখক। প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার এই বইটিতে তাঁদের বক্তব্য: আমরা যা রোজ দেখি, রোজ শুনি, ক্রমশ তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, আর তাই দারুণ আনন্দের মিলন বা ভয়ানক দুঃখের বিরহ, দুই-ই দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন চর্বিতচর্বণের জন্য বই লেখা কেন? প্রশ্নটা একেবারে অযৌক্তিক নয়; নানা পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা ও ক্ষেত্রসমীক্ষা করে শেষ অবধি অনেক কথাই বলেছেন লেখকরা, যা নিতান্তই কাণ্ডজ্ঞানের কথা। তা সত্ত্বেও এ বই মূল্যবান। কেবল তরতর করে পড়ে যাওয়া বলে নয়, অন্য নানা কারণেও। একটা কারণ: এর পাতায় পাতায় আছে নানা খবর, যা একই সঙ্গে চমক দেয়, ভাবিয়ে তোলে। যেমন, বছর দশেক আগের এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, গড়পড়তা নাগরিক নিজের জীবনের যে পর্বটিকে সব থেকে সুখের সময় বলে চিহ্নিত করে, নানা দেশে সেটা নানা রকম। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে মধ্য-চল্লিশ, ভারতে মধ্য-পঞ্চাশ, রাশিয়ায় সত্তর-আশি! এ কি সত্য সকলই সত্য? জানা নেই, তবে কার্যকারণ নিয়ে বিস্তর ভাবনার খোরাক আছে বইকি।
লুক আগেন
ট্যালি শ্যারট, ক্যাস আর সানস্টেন
৬৯৯.০০
দ্য ব্রিজ স্ট্রিট প্রেস
আবার অনেক সময় জানা-কথাও মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার হয়। যেমন, নানা ধরনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে লেখকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সারা বছরের (বা সারা জীবনের) বেড়ানোর বাজেট করার সময় লম্বা সফরের বদলে ছোট ছোট ভ্রমণের পরিকল্পনা করা ভাল, তাতে মোট আনন্দ বেশি হবে। কাজের কথা।
তবে এই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান বারো নম্বরটি। প্রধানত ১৯৩০-এর দশকের জার্মানির দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে সেখানে দেখানো হয়েছে, স্বৈরতন্ত্র যখন ক্রমে ক্রমে সমাজের শ্বাসরোধ করতে থাকে, তখন কী ভাবে নাগরিকরা— ক্রমে ক্রমেই— সেই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং সেই অভ্যাস উত্তরোত্তর দ্রুততর গতিতে একাধিপত্যের পথ মসৃণ করে দেয়। এই বৃত্তান্তও আমাদের অজানা নয়, কিন্তু বার বার তাকে জেনে নেওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy