শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত সহজপাঠ
ত্রিদিব বসু
আনন্দ পাবলিশার্স, ২০২০
কথামৃত এমনিতেই এক সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে বহু সহজ-সরল মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়েছে। কোনও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব জটিল হয়ে ওঠেনি শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে। এমন যে কথামৃত, তারও কি কোনও ‘মেড ইজ়ি’ দরকার? কথামৃতকে বোঝানোর জন্য অনেকেই বই লিখেছেন, সেখানে খেটেখুটে বিষয়বস্তুগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। পল্লবিত হয়েছে ব্যাখ্যাগুলিও। ত্রিদিব বসু তবু কথামৃতকে নিয়ে একটি সহজ বইয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছেন। কথামৃতের ভাষার বাইরে তিনি একটি শব্দও বাড়তি যোগ করেননি, ভূমিকাটি ছাড়া। তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে, এই বই প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেকটাই।
সঙ্কলক বা সম্পাদক যা-ই তাঁকে বলি, তিনি সম্পূর্ণত কথামৃতের প্রতি বিশ্বস্ত। তাঁর বিশ্বাসের রূপটি বইয়ের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে— রেফারেন্স বা উদ্ধৃতির উৎসগুলিতে। একটা বাক্যও যখন কথামৃতের বাইরে নেই, তখন পড়তে গেলে আসল কথামৃতই পড়ব, এমন মানসিকতা পাঠকের থাকতেই পারে। সম্পাদক কিন্তু এখানেই বাজিমাত করেছেন। তিনি বলবেন, “নিশ্চয়ই পড়বেন— মূল কথামৃত; কিন্তু সেখানে যে-সব বিষয়ের কথা এক-একদিন যে ভাবে ব্যক্ত হয়েছে সে-সে বিষয়গুলির উপর আলোচনা করতে হলে সমগ্র কথামৃতটি প্রথমে পড়তে হয়। তার পর অত্যন্ত কষ্ট স্বীকার করতে হবে— সেগুলিকে এক জায়গায় বা একটি প্রবন্ধে আনার জন্য।” এখন এ কাজটি করা সুবিধা হয়েছে, কালানুক্রমিক কথামৃত (অখণ্ড) প্রকাশিত হওয়ার পর। শ্রীম পাঁচ খণ্ডে কথামৃত প্রকাশ করে গিয়েছেন, কিন্তু কালানুসরণ করেননি। তার কারণও ছিল। তিনি যে দিনগুলির কথা বেশি মূল্যবান বলে মনে করেছেন, সেই দিনগুলির কথামৃতই প্রথম খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, পরের খণ্ডটি বার করতে পারবেন না। এ ভাবেই পঞ্চম খণ্ড পর্যন্ত চলেছে কথামৃতের যাত্রা।
কথামৃতের সাগর থেকে যে রত্নসম্ভার মেলে তাদের ভাগ ভাগ করে রাখারও প্রয়োজন আছে। বইটি যে প্রয়োজন মিটিয়েছে। কথামৃতের মূল কথা: মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। লক্ষ করার, শ্রীরামকৃষ্ণ এই লক্ষ্য পূরণের পথে বার বার সাধনার কথা বলছেন, যার মূলে আছে ‘কাম-কাঞ্চন’ ত্যাগ। অথচ মানবসমাজ মূলত এই দু’টি নিয়েই ব্যস্ত। যাঁরা আস্তিক (ঈশ্বর ও শাস্ত্রে বিশ্বাসী) তাঁরা সাধ্য (ঈশ্বর লাভ) ও সাধনার (কাম-কাঞ্চন ত্যাগ) মধ্যে ভেদ দেখেন না, যথাসাধ্য সামঞ্জস্য রেখে উদ্দিষ্ট পথে অগ্রসর হন। নাস্তিকদের কাছে আবার কাম-কাঞ্চন ত্যাগের প্রশ্নটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রথম পাঠে বিভ্রান্তি আসে, সঙ্গে বিরোধিতাও— কথামৃতে আছেটা কী? কাম-কাঞ্চন ছাড়া জগৎ চলে! কিন্তু দেখা গিয়েছে, সংসারপথে আহত জর্জরিত হয়ে তাঁরাই কথামৃত কিনে পড়ছেন বা বন্ধু-পরিজনদের পড়াচ্ছেন।
কেন এই ‘পরিবর্তন’? অভিজ্ঞতা। ‘বিজ্ঞান’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাঁরা বুঝেছেন, ‘ম্যাটার’-এর মধ্যে ঐক্য ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান এনেছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে ঐক্য আনতে হলে ওই কামনা ও কাঞ্চনের মোহ ত্যাগ করতেই হবে। ওই দু’টির জন্যই মানুষ লোভী, স্বার্থপর। মানুষে মানুষে সমতা আনতে সবচেয়ে বড় ওই দু’টি প্রতিবন্ধককে পেরোতে হবে, অথবা সংযত করতে হবে। কথামৃত সহজপাঠ সেই মহৎ ইষ্টসাধনের জন্য খুব সরল কথায় আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সবার কাছে গিয়ে আশ্বাস দিতে চায়, মূল কথামৃতের ১৩৮০ পৃষ্ঠা পড়ার তাগিদও অনুভব করায়। এ এক অভিযাত্রা, যে যাত্রায় জড় তম-দেহ ভেদ করে, শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘চৈতন্যের’ স্রোত প্রবাহিত হবে। সেটাই মানুষের মধ্যে দেবত্বের বিকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণ যে কথা বার বার বলতেন— শুধু দয়া প্রদর্শন নয়, ‘জীবের মধ্যে শিব’ দর্শন করে, ‘মানুষই স্বরূপত ব্রহ্ম বা শিব’ এই ভাব নিয়ে নূতন অর্থবহ এক ‘শিবসেবা’ শুরু হবে বিশাল আকারে। এ ভাবেই জীবনের মাঝে উৎসবের উৎসার হবে, শাস্ত্রোক্ত তত্ত্বগুলি মানুষের ব্যবহারিক জীবনে ঝলমল করে উঠবে।
সুপাঠ্য কথামৃতে তত্ত্বকথাও সুপ্রচুর, এবং তা প্রয়োজনীয়ও। এই বই ঘুরে এসেছে সেই পরিসরে। ‘জীব-জগৎ-ঈশ্বর’ নিয়ে এই সৃষ্টি। জীব ও ঈশ্বরের মাঝে জগৎ অবস্থান করছে। এই জগৎ থেকেই ‘গুরুশক্তি’ আহরণ করে শক্তিমান হয়ে জীব ঈশ্বরকে হৃদয়ে ধারণ করে। জীব তখন ভক্ত, ঈশ্বর ভগবান। ভক্ত অবিনাশী, ভগবানও অবিনাশী। সুতরাং, দু’টি সত্যই থাকল। তাই দ্বৈতবাদ। দ্বৈতবাদীরা সাকারবাদী, এঁদের জন্য মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা। আর এক দল আছেন, তাঁরাও জীব-জগৎ-ব্রহ্ম ত্রিতত্ত্বের কথা বলেন। এঁদের কাছেও জীব এই মিথ্যা জগৎ থেকেই গুরুকে প্রাপ্ত হন, সেই গুরুসহায়ে পান নিরাকার ব্রহ্মকে, যিনি সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। জীব তখন দেহধারী নন, মনোময় প্রাণময় বিজ্ঞানময়ও নন, জীব তখন শুদ্ধ আত্মা। গুরুও তখন পৃথক রূপে নেই, গুরু লীন হন ব্রহ্মে। সচ্চিদানন্দই গুরু। এ তাঁরই কথা। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পিছনে তখন পরম সত্য, নিরাকার ব্রহ্মরূপে (নাম-রূপহীন) প্রতিভাত হন। জীবও স্বরূপত ব্রহ্ম, অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত বলে খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। এরই নাম অদ্বৈত তত্ত্ব, নিরাকার ব্রহ্মই তার বিষয়। রামকৃষ্ণ দ্বৈত অদ্বৈত সব মিশিয়ে দিলেন— সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ, সচ্চিদানন্দ শিব, সচ্চিদানন্দ কালী, সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। সৎ চিৎ ও আনন্দ নিয়ে সবাই সম্মুখে বর্তমান। সুতরাং কৃষ্ণ, শিব, কালী, ব্রহ্ম, আল্লা, গডে পার্থক্য কোথায়? কঠিন অধ্যাত্মতত্ত্বকে সহজ করে বলা হয়েছে কথামৃতে। তিনি সবাইকে নিয়ে আছেন, সব তত্ত্ব ও শাস্ত্র মন্থন করে তুলে এনেছেন একটি পরম বাক্য— ‘যত মত তত পথ’।
রামকৃষ্ণকথামৃতকে প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠায় পরিবেশন করেছেন সঙ্কলক। রেখেছেন চারটি অধ্যায়, প্রতিটিই প্রশ্ন-উত্তরের আকারে সঙ্কলিত। এ ছাড়াও পাঁচটি বিভাগে বিন্যস্ত সুদীর্ঘ পরিশিষ্ট; সংসার, সংসারী, বিষয়ীদের নিয়ে প্রশ্ন; সাধু, আচার্য, সদ্গুরু, লোকশিক্ষক, যোগীর বৈশিষ্ট্য; ঈশ্বরতত্ত্ব ও সাধনপথের টুকিটাকি। চতুর্থ অধ্যায়টি— ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন’ কৌতূহল জাগায়, বিবিধ সংশয়ের নিষ্পত্তিও ঘটায়। পরিশিষ্টগুলি এমন ভাবে সাজানো, যেন বহুবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন মানুষটি একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।
কথামৃতের জোর আসলে রামকৃষ্ণসত্তার জোর। আলোচ্য বইটি পাঠে পাঠকও সেই জোর পাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy