—প্রতীকী চিত্র।
নারীর নারীত্ব বা মনুষ্যত্ব থেকে বুদ্ধত্বের পথে উত্তরণের কাব্যময় অভিব্যক্তি থেরীগাথা। দ্বৈতভূমির ভেদাত্মক অহং বা আত্মবোধ থেকে বিমুক্ত অনাত্ম অর্থাৎ ভূমাযাপনের কথাবস্তু। “ইদং সন্ধায় ভগবানাহ— সর্বধর্মা ন স্ত্রী ন পুরুষঃ ইতি। (বিমলকীর্তিনির্দেশসূত্র)।” বুদ্ধ বলছেন, কোনও কিছুর মূল স্বভাবে স্ত্রী বা পুংত্ব নেই, সেটি কেবল ব্যবহারিক জগতেই সীমাবদ্ধ। থেরীগাথা-য় স্থবিরা সোমার উপলব্ধিতে সেই সত্যই ধরা পড়েছে। ভারতীয় বৌদ্ধ-পরম্পরায়, অন্তত শাস্ত্রাদি রচনায় পুরুষের প্রাধান্য; পরবর্তী কালে সিদ্ধদের জীবনীতে সিদ্ধ হিসেবে এবং তাঁদের অনেকের গুরু হিসেবে নারী গুরু বা ডাকিনী অর্থাৎ প্রজ্ঞানময়ী আচার্যার উল্লেখ পাই, সে-ও পুরুষের তুলনায় খুব কম। স্বাতী ঘোষের গ্রন্থের ভূমিকায় এই সুরটি ধ্বনিত। থেরীগাথা-র সংস্কৃত পাঠের অনুপস্থিতি তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছেন।
‘প্রথম মানবীর স্বর’ কথটিতে কেউ যদি আপত্তি তুলে বলেন, প্রাচীনতর সাহিত্য ঋগ্বেদের অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্, ঋষিকা সূর্যা প্রমুখের যে উপলব্ধির কথা তাঁরা পদ্যে নিবদ্ধ করে ব্যক্ত করেছেন, আক্ষরিক অর্থেই উদাত্ত-অনুদাত্ত ইত্যাদি স্বরচিহ্ন সহকারেই যা যথাবৎ রক্ষিত, তাকে মানবীয় স্তর থেকে সরাব কোন যুক্তিতে? থেরীগাথা-কে মেয়েদের প্রথম কাব্য-সঙ্কলন বলা যেতে পারে, কিন্তু প্রথম স্বর সেটি নয়। লেখিকাও ভূমিকায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘পৃথিবীর মেয়েদের প্রথম সম্পূর্ণ কাব্য-সংকলন’। তাই গ্রন্থনামে ‘স্বর’-স্থানে ‘সঙ্কলন’ হলেই যথাযথ হত। চার্লস হেলিসে-কৃত অনুবাদের নামে রয়েছে থেরীগাথা: পোয়েমস অব দ্য ফার্স্ট বুদ্ধিস্ট উইমেন।
মূল থেরীগাথা-র সঙ্কলনে গাথাগুলি ছোট থেকে বড় এই ক্রমে বিন্যস্ত। ভিক্ষু শীলভদ্রের বাংলা অনুবাদটি (১৯৪৫) সেই মূলক্রম রেখেই করা; প্রতিটি গাথার সঙ্গে ভিক্ষু ধর্মপাল রচিত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের পরমত্থদীপনী-র বিবরণ গেঁথে বইটি তৈরি। সেই বিবরণে সংশ্লিষ্ট গাথার প্রণেতা থেরী, তাঁর প্রেক্ষাপট বিবৃত। অন্য দিকে স্বাতী নিজের ভাবনামতো বিষয়সাযুজ্যে সাজিয়ে চারটি অধ্যায়ে গাথাগুলি পরিবেশন করেছেন। অধ্যায়ের শিরোনাম ও উপশিরোনাম বিষয়কে আলোকিত করেছে। সেই সাজানোর চালচিত্রের সন্ধান লেখিকা ভূমিকায় স্পষ্ট করেছেন। গাথা-বিষয়ক সংশ্লিষ্ট আলোচনায় বর্তমান কালের নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয় তুলে এনেছেন, যা থেরীগাথা-র সামাজিক আঙ্গিক বুঝতে সহায়ক হবে। রয়েছে কিছু টীকাও।
থেরীগাথা: প্রথম মানবীর স্বরভূমিকা, টীকা,
অনু: স্বাতী ঘোষ
৬০০.০০
সিগনেট প্রেস
ভূমিকায় বিষয়-প্রবেশিকা হিসেবে বুদ্ধ-দেশিত ধর্ম-দর্শন-ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু মূলগত সমস্যাও থেকে গেছে। যেমন, বুদ্ধের ধর্ম “গৃহস্থাশ্রমের ধর্ম নয়”। অথচ বুদ্ধের উপদেশ বা সদ্ধর্ম চতুর্বিধ পরিষদ অর্থাৎ ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, উপাসক, উপাসিকা— সকলের জন্যই অবারিত ছিল। বুদ্ধের দেশনা বা ধর্মের তাৎপর্য কেবল বাহ্য-ভিক্ষুত্বের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং নির্বাণের লক্ষ্যে ধাবিত। এই ভাবধারাই পরবর্তী কালে সিদ্ধাচার্য ও যোগীদের চর্যায় প্রতিবিম্বিত। শুধু থেরীগাথা বা থেরগাথা-র নিরিখে বুদ্ধ-শাসনকে বিচার করলে হবে না। দ্বিতীয়ত, মহাযানী পন্থায় নাকি “বুদ্ধ হয়েছেন ঈশ্বর, এবং শাক্যমুনি সিদ্ধার্থ আর পরবর্তী বোধিসত্ত্বরা ঈশ্বরের অবতার”— এখানে ঈশ্বরের লক্ষণ স্পষ্ট করা জরুরি ছিল। হিন্দু-পৌরাণিক ঈশ্বরের লক্ষণ আর বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় ঈশ্বরের লক্ষণ এক নয়। বৌদ্ধ শাস্ত্রে ঈশ্বর বলতে কখনওই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কর্তা বা ন্যায়প্রস্থান-সিদ্ধ নিমিত্ত কারণ ঈশ্বরকে বোঝানো হয়নি। সে অর্থে শাক্যমুনি বুদ্ধ বা অবলোকিতেশ্বর কেউই ঈশ্বর বলে চিহ্নিত হননি। এমন অতিসরলীকরণ বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় বোধকে ব্যাহত করে।
“পরবর্তীকালে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রবল পরাক্রম যখন ভারতে সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠিত, তখন একসময় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয় বৌদ্ধ ধর্ম।” ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রবল পরাক্রম’কাল বলতে কি গুপ্তরাজাদের শাসনকালের কথা বলা হচ্ছে, যা ব্রাহ্মণ্যধারার ‘সুবর্ণযুগ’, একই সঙ্গে নালন্দারও যখন বাড়বাড়ন্ত! না কি লেখিকা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে মুসলমান আক্রমণের কালটি ধরতে চেয়েছেন? বৌদ্ধ-পরম্পরা মূল ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে কি একেবারে বিলুপ্ত হয়েছিল কখনও? থেরীগাথা ‘মেয়েদের প্রথম লেখা’ বলাও সঙ্গত নয়: থেরীরা গাথাগুলির প্রণেতা, কিন্তু তাঁরাই সেগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায় না। ‘বৌদ্ধ ধর্ম নির্যাস’ অংশে বুদ্ধ-উপদিষ্ট ধর্মের ভিত্তিস্বরূপ প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বের প্রসঙ্গ আসেনি। জন্মজন্মান্তর ধরে প্রবাহিত কর্মসন্ততির কার্য-কারণ যোগ, লেখিকার মতে যা ‘থেরবাদী ভাবনায় ছিল না’ (অথচ পালিস্রোতে এই বক্তব্যের সমর্থন পাই না), সেগুলোই ‘বৌদ্ধ ধর্ম নির্যাস’ অংশে অষ্টাঙ্গ মার্গ-দেশনার আলোচনায় স্থান পাওয়ায় পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন।
অনুবাদের ভাষা ঝরঝরে, নির্মেদ। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভাবানুবাদ থেকে মূল ভাবটি সরে গেছে। যেমন, থেরী শিশুপচালার (সীসূপচালা) গাথা। “জানা আছে চারসত্য, দুঃখ জগৎ জোড়া, দুঃখের কারণও সংগত, তবে দুঃখ নিবৃত্ত করা যায়—/ বৌদ্ধ অষ্টাঙ্গমার্গে চলে দুঃখ দূর হয়।// তাঁর কথা মেনে, মন সাধনায় সঁপে,/ আজ ‘তেবিজ্জ’ অধিগত, তমসার ঘোর কোটে [কেটে] গেছে,/ মার, তুমি ব্যর্থ, পরাজিত।” মূল গাথা দুটো: “তস্সা’হং বচনং সুত্বা বিহরিং সাসনে রতা।/ তিস্সো বজ্জা অনপ্পত্তা কতং বুদ্ধস্স সাসনং।। সব্বৎথ বিহতা নন্দি তমোক্খন্ধো পদালিতো।/ এবং জানাহি পাপিম, নিহতো ত্বম’সি অন্তক।।” অর্থাৎ তাঁর (বুদ্ধের) উপদেশ শুনে সেগুলি অনুরূপ ভাবে অনুশীলন করে আমি ত্রিবিধ বিদ্যায় সিদ্ধিলাভ করে বুদ্ধের উপদেশ পালন করেছি ইত্যাদি। বুদ্ধের শিক্ষায় চতুরার্যসত্য অন্যতম ভিত্তিস্বরূপ, এই গাথায় তার প্রসঙ্গ নেই। তাই অনুবাদে এমন অনাবশ্যক জুড়ে-দেওয়া অনুবাদকে ছিন্ন ও ভিন্ন করেছে। গাথার ভাবানুবাদে বারংবার ‘বৌদ্ধ’ শব্দটির ব্যবহারও অনুবাদের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস করে, কারণ মূল গ্রন্থে কোথাও শব্দটি প্রযুক্ত হয়নি।
তবে ‘মিছরির রুটি’ যে ভাবেই খাওয়া হোক মিষ্টি লাগবেই। অনুবাদিকা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের নারীর অধ্যাত্মসঙ্গীত বর্তমানের প্রেক্ষিতে নতুন বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। তা আমাদের মূল গ্রন্থটির প্রতি প্রণোদিত করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy