আস্ত বিরিয়ানি-কোষ নয়, এ আসলে বিরিয়ানি বলতে বাঙালি যা বোঝে সেটুকুই। নইলে আর উনিশ শতকে সিলেটে আলুর চাষ শুরুর উৎসাহদাতা কতিপয় ইংরেজ সাহেবকে কেন এ বই উৎসর্গ করা হবে। তেনাদের ‘ক্যালকাটা বিরিয়ানি’র অদৃশ্য ‘নেপথ্য পুরুষ’ সাব্যস্ত করে এ বই গোড়াতেই কলকাতার বিরিয়ানি নিয়ে কিছু মিথ ভাঙার জমি প্রস্তুত করে রাখে।
গরিবগুর্বোর বিরিয়ানি-আহ্লাদ চরিতার্থ করতে মহার্ঘ মাংসের বিকল্প হিসাবে ওয়াজ়িদ আলি শাহ মেটিয়াবুরুজে আলুর বিকল্প ফাঁদলেন, এই বিশ্বাস যুগবাহিত। কিন্তু তার বাস্তব ভিত্তি সন্দেহজনক। এ বইয়ে অন্তত দু’টি লেখায় বিরিয়ানির আলু-সূত্র স্পষ্ট করার চেষ্টা। ভাতের বিকল্প হিসাবে আলুর প্রসারে ইংরেজরা অনেক দিনই চেষ্টা চালাচ্ছিল, ততটা সফল হয়নি। তবু একখণ্ড রসস্থ আলুই ক্রমশ বিরিয়ানির প্রতীক হয়ে ওঠে। এর পিছনে কলকাতার রেস্তরাঁকুলেরই মুখ্য ভূমিকা। হায়দরাবাদি বিরিয়ানির অনুষঙ্গে সালান বা থালাপ্পাকাট্টি বিরিয়ানির ডাল-বেগুনের ঝোলও গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাঙালির বিরিয়ানির আলু-আবেগের মাত্রা সীমাহীন।
এ বই দেখায়, ওয়াজ়িদ আলি শাহর জীবনের শেষ পর্বে লেখা বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাক-প্রণালী-তে পোলাওয়ের জয়জয়কার। ‘জ়ের বিরিয়ান’ গোছের দু’একটি মাত্র রেসিপি, যা বাদশা শাহজাহানের আমলের নুসখা-ই-শাহজাহানি থেকে আহৃত, তাতে আলুর নামগন্ধ নেই! কয়েকটি লেখায় বিরিয়ানির ইতিহাস খুঁড়তে গুজিস্তা লখনউ, নুসখা-ই-শাহজাহানি থেকে আবুল ফজ়লের লেখারও উদ্ধৃতি। জয়িতা দাসের লেখায় নলের পাকদর্পণম্-এর আস্বাদ, ইয়াখনির সুবাস; লখনউয়ের নবাবি নিমতখানার নানা গল্প: কোন পোলাও তিন চামচের বেশি খেলেই নবাব অসুস্থ হয়ে পড়বেন, কোন বাবুর্চির কেরামতিতে এক চামচ পোলাওতেই পালোয়ানের পেট আইঢাই!
বিরিয়ানির বই
সম্পা: সামরান হুদা, দামু মুখোপাধ্যায়
৭০০.০০
৯ঋকাল বুকস
গুজিস্তা লখনউ-এর লেখক শরর অতি পরিশীলিত নবাবি পোলাওয়ের পাশে বিরিয়ানিকে ‘কুৎসিত’ আখ্যা দিয়েছেন। পোলাওয়ের পাশে বিরিয়ানির অর্বাচীনতা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ বইয়ে দেখি বাঙালি চেতনায় বিরিয়ানির কাচ্চি, পাক্কি, তেহরি, মোরগ পোলাও সবই ঘেঁটে ঘ। ‘ঢাকাইয়া বিরানি’র এ কালের অবক্ষয়-কথা বা হাজি-র বিরিয়ানি পাজিদের দখলে যাওয়ার আখ্যান পড়ে বিমর্ষ হই। তবে কৃতী ইঞ্জিনিয়ার হয়েও পেশায় লাইফস্টাইল সাংবাদিক নাদিমা জহানের সরস লেখাটি রসনাবোধ ও বিরিয়ানির রসায়ন-চেতনার মিশেলে উপভোগ্য। বিরিয়ানি মানে শুধু নবাব-বাদশাদের গল্পই নয়, দেশভাগের সময়ে বিহার থেকে ঢাকায় আসা ফখরুদ্দিন নামী ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছেন। ঢাকা, মীরপুরের উর্দুভাষী বিহারি ক্যাম্পের বিরানি ইতিহাস, রাজনীতির আয়না।
তবে ঢাকা বা কলকাতার বিরিয়ানির গল্পের আধিক্যে কয়েকটি লেখা পুনরুক্তিময়। ‘ব্যারাকপুর বিরিয়ানি’র একটি উত্থান-কাহিনি থাকা উচিত ছিল। দক্ষিণ ভারতের ডিন্ডিগুল, আম্বুর বা থাল্লাসেরি বিরিয়ানির মতো দাদা-বৌদির হোটেলের সৌজন্যে ব্যারাকপুরের ‘বিরিয়ানিপুর’ হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। শিবাংশু দে-র লেখায় লখনউয়ের ইদ্রিস বা লাল্লার বিরিয়ানির গল্প উপাদেয়। তবে হায়দরাবাদি বিরিয়ানির নানা বৈশিষ্ট্য নিয়েও আলাদা লেখা থাকতে পারত। আর পাকিস্তানের বিরিয়ানির খুঁটিনাটি ছাড়াও উপমহাদেশের বিরিয়ানি-চর্চায় ফাঁক থেকে যায়।
বাঙালির বিরিয়ানি কত জনের আত্মজীবনীরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ! রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিস্টিক্সের শিক্ষক তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত বা মু্ম্বইপ্রবাসী দেবলীনা রায়ের লেখা দু’টি প্রবাসী পশ্চিমবঙ্গবাসীর দূরদেশে চেনা বিরিয়ানির জন্য আকুতিতে ভরপুর। কলকাতার আলুময় বিরিয়ানির বিরহকাতরতা থেকে ক্রমে পৃথিবীর বিরিয়ানি বৈচিত্র বুঝতে শেখা ও শেষে নিজে বিরিয়ানি রান্নার লাইফ স্কিল রপ্ত করার কাহিনি এক উত্তরণেরও গল্প। সাবিনা ইয়াসমিন রিঙ্কুর লেখায় গ্রাম থেকে শহরে এসে বিরিয়ানি রান্নায় তালিম নিতে উন্মুখ মেয়ের পোশাকে লেপ্টে থাকে বিরিয়ানির গন্ধ। সামরান হুদার লেখায় কলকাতার ঘিঞ্জি মহল্লায় ঘেঁষাঘেঁষির সংসারে আটপৌরে হেঁশেলে বিরিয়ানির জন্মকথা।
দক্ষিণের বিরিয়ানি বা ভাত-মাংসের সৌজন্যে বিরিয়ানির তুতো বোন শিলংয়ের জা-ডো নিয়ে লেখা স্বাদ বদলের ছোঁয়া আনে। তবু এ বই আদতে বিরিয়ানি ও বঙ্গসমাজের আনাচে-কানাচে ঘুরপাক খায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy