প্রতীকী ছবি।
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার-এর সেই কথাটার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে এই বই গ্রন্থনার সুতোটা। ভলতেয়ার বলেছিলেন, “পশ্চিমের মানুষ সব দিক দিয়েই পুব পৃথিবীর মানুষের থেকে অনেক উন্নত, ওদের বাধা অতিক্রম করেও আমরা ওদের কাছে সে কথা প্রতিষ্ঠা করেছি, ওদের ভাষা শিখেছি, আমাদের কিছু শিল্পবোধ ওদের শেখাতে পেরেছি। তবে একটা জায়গাতেই প্রকৃতি ওদের থেকে আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। সেটা হল, ওদের আমাদের কোনও দরকার নেই, কিন্তু আমাদের ওদের খুব দরকার।”
দরকারটা স্পষ্ট। ওদের দরকার প্রাচ্যের প্রকৃতি, প্রাচ্যের সম্পদ, সম্ভার। ইউরোপীয়রা যে ষোলো-সতেরো শতক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল পুবের দিকে, সে মুখ অমনই রইল কয়েক শতাব্দী জুড়ে। সম্পদের জন্য লুঠপাট, লুঠপাটের জন্য সাম্রাজ্যবিস্তার, সাম্রাজ্যের জন্য আলোকায়ন ও গোলকায়ন— সবই হল ক্রমে। প্রাচ্যের দিকে পশ্চিমের এই যে অভিযান, একে তাই অজানাকে জানার অসীম কৌতূহল, অন্তহীন আগ্রহ ইত্যাদি বলে বর্ণনা করার মধ্যে একটা ভুল আছে। সত্যিটা হল— প্রাচ্যের জন্য প্রতীচ্যের প্রয়োজনবোধ, আর সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য কামনা-বাসনাই উপনিবেশ-ইতিহাসের মূল। এই বইয়ের ধরতাইটা এখানেই— কামনা বা ‘ডিজ়ায়ার’-এর মধ্যে। এ এল ব্যাশাম-এর দি ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়জ় ইন্ডিয়া কিংবা রোনাল্ড ইনডেন-এর ইম্যাজিনিং ইন্ডিয়া-র নরম শব্দচয়নে বোধহয় হারিয়ে যায় এই কামনা বা ডিজ়ায়ার-এর বৃত্তান্ত।
বইটির মূল উপপাদ্য ভূমিকা প্রবন্ধে বেরিয়ে এসেছে সুন্দর ভাবে। ভারত নিয়ে ইংরেজ ও ফরাসি অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথমে আলোচনাসভা, তার পর বই প্রকাশ। সম্পাদক যখন লেখক, টাভার্নিয়ের-এর ভ্রমণরচনার মনোগ্রাহী আলোচনার মধ্যে বইয়ের প্রতিপাদ্যটি সুন্দর আঁকেন তিনি।
বারোটি প্রবন্ধের মধ্যে প্রথমেই যে লেখার কথা বলতে হয়, সেটি সুপ্রিয়া চৌধুরীর। প্রথম ইংলিশ পর্যটক যখন সাগর পেরিয়ে ভারতে এসেছিলেন, এই লেখায় সেই কাহিনি। র্যালফ ফিচ ভারতে এসেছিলেন ১৫৮৩ সালে, ছিলেন ১৫৯১ সাল পর্যন্ত। একটি ছোট আখ্যানের মধ্যে কী ভাবে বড় আখ্যান বুনতে হয়, তার অতীব জরুরি পাঠ আছে এই লেখার মধ্যে। এই সেই সময় যখন পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মধ্যে সংযোগসূত্র তৈরি হওয়ায়। ইংল্যান্ডে তখনও শেক্সপিয়র যুগ, আর ভারতের পুব প্রান্তে বাংলায় মঙ্গলকাব্য লিখে সবে গত হয়েছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। এঁরা কেউ জানতেন না সে দিন, তাঁদের অলক্ষ্যে কী ঘটে চলেছে দুনিয়া জুড়ে। ফিচও না। ফিচ বাংলার উত্তরে কোচবিহার থেকে দক্ষিণে সপ্তগ্রাম অবধি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পুবে চট্টগ্রামও যাচ্ছেন। বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা ছড়িয়ে চার দিকে। বার্নিয়ের এই দেখেই লিখেছিলেন, “মিশরের থেকেও যেন বেশি কৃষিসম্পদ এই বেঙ্গল-এ।” কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছিলেন না ফিচ, পর্যটনই করছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে পড়ছিল অতুল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। সেই ঐশ্বর্য, যা বাংলার মঙ্গলকাব্যের মতো স্থিতসভ্যতার ধারক-বাহক।
একই গোত্রের লেখা রমিতা রায়ের ‘ক্যান্টন টু ক্যালকাটা’, চা বাণিজ্যের ইতিবৃত্ত, বা জয়তী গুপ্তের নীলচাষ আখ্যান। একটি প্রাচ্য বস্তু ‘নীল’-এর আবিষ্কার এবং তার জন্য ‘কামনা’ কী ভাবে পাল্টে দিচ্ছে পশ্চিমি কলকারখানা এবং শিল্পসভ্যতার ভিতরকার হালচাল: এ এক আশ্চর্য গ্লোবাল গল্প। ১৭৭৯ থেকে ১৮১৬ পর্যন্ত অন্তত চার বার জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছেন এলিজ়া ফে। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তেও সেই নতুন গ্লোবাল পৃথিবীর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। এর পরই কারও জন হাটনাইক-এর মার্ক্স-এর ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ বিষয়ক লেখাটি পড়তে ইচ্ছে হতে পারে, জ্যোতি মোহনের ফরাসি চোখে ভারত ইতিবৃত্তও। আস্তে আস্তে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জেগে উঠছে ইন্ডিয়া-সচেতনতা এবং ইন্ডিয়া-আগ্রহ: ইন্ডিয়ার প্রতি ডিজ়ায়ার-এর সঙ্গে।
প্রশ্ন হল, প্রাচ্যের সমাজে নারী: এ নিয়ে এত যে কৌতূহল, এর মধ্যেও কি সেই ডিজ়ায়ার-এরই আর এক জটিল রূপ লুকিয়ে নেই? আনা বেকার-এর ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজ়ম’ ও ‘ফিমেল বডিজ়’-এর উপর লেখাটি নতুন করে ভাবানোর মতো। মোগল সম্রাটদের নারীপ্রেম এবং শিল্পসংস্কৃতিতে তার প্রতিফলন, আর তার পাশেই বৃহৎ সমাজে নারী-নিষ্পেষণের বিশাল বাস্তব: কেমন ভাবে ধরা পড়েছিল ইউরোপীয় মানুষের চোখে? জননী কল্যাণী ভি-র লেখায় আসে আঠারো-উনিশ শতকের ফরাসি নাট্যসাহিত্যে ভারতীয় বিধবার বর্ণনা।
স্বাতী দাশগুপ্তের লেখায় সিপাহি বিদ্রোহে ভারতীয় মহিলাকাহিনি— বইয়ের কেন্দ্রীয় বিষয়ের তুলনায় খানিক ভিন্ন স্বাদের। তবে সুলিখিত। একই ভাবে, বইয়ের শেষ লেখাটিতে ফরাসি ঔপনিবেশিকদের ভারতীয় সঙ্গীত আবিষ্কার করার গল্পও সৌম্য গোস্বামী বলেছেন আগ্রহসঞ্চারক ভাবে। কিন্তু বইয়ের মূল থিম থেকে কি সরে গিয়েছে এটিও?
উনিশশো সাতচল্লিশ সালের পঁচাত্তর বছর পূর্তির উৎসব এখন আমাদের চতুর্দিক ঘিরেছে। ১৯৪৭ সালকে কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাসের পোস্ট-কলোনিয়াল যুগেরও সূচনাবিন্দু ধরা যেতে পারে। উপনিবেশ-দুনিয়ায় একটা পর্দা নেমে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যে ভাবে সেই ষোলো-সতেরো শতক থেকে অপ্রতিহত গতিতে চলছিল অশ্বমেধের রথ, তাতে পড়েছিল একটা অবসান-চিহ্ন, অন্তত বাহ্যিক আকারে। এই রকম সময়ে এমন একটি বই পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক অসাধারণ আখ্যান। এক পৃথিবীর প্রতি আর এক পৃথিবীর কামনা-বাসনার আখ্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy