মরু রাজ্যে অলিভ চাষ। তাপমাত্রা-আর্দ্রতাও নিয়ন্ত্রণ করছে যন্ত্র।
বিন্দু বিন্দু জলে হয়তো সিন্ধু হয়নি। কিন্তু সেচের বন্দোবস্ত করেছে রাজস্থান। এতে মরু-রাজ্যের ঊষর মাটিতে যে শুধু ফসল ফলছে তা-ই নয়, চাষবাসকে আঁকড়ে নতুন প্রজন্ম নতুন ভাবে জমিতে ফেরার কথাও ভাবতে শুরু করেছে বলে তাদের দাবি।
‘কাঁধে ফের লাঙল তোলার ইচ্ছে’কে উস্কে দিতে বিদেশ (বিশেষত ইজরায়েল ও অস্ট্রেলিয়া) থেকে শিখে আসা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরছে মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার সরকার। রোজগারের জায়গা হিসেবে কৃষিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে জোর দিচ্ছে ফল, সব্জি ও অর্থকরী ফসল উৎপাদন আর চুক্তি-চাষে। মোটা মুনাফার ফসল বেশি করে ফলাতে আর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ টানার জন্য লাল ফিতের ফাঁস আলগা করতেও পা বাড়িয়েছে তারা।
রাজস্থানের কৃষি দফতরের সচিব নীলকমল দরবারির কথায়, ‘‘খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি যে, কোন কোন জিনিস পছন্দসই নয় বলে চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নতুন প্রজন্ম। চেষ্টা করছি প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই জায়গাগুলিকে বদলে যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার।’’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছিলেন, হাতে কাদা লাগলে কিংবা মাঠে ধুলো-মাটি ঘাঁটতে আজকের প্রজন্মের অনেকের কিছুটা বাধবাধ ঠেকে। কিন্তু এখন উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে তার অর্ধেক কাজ সেরে দেয় মেশিনই। ফলে ঠিকঠাক কৃষিনীতি তৈরি করলে, তাঁদের জমিতে টেনে আনা অসম্ভব নয় বলেই দরবারির দাবি।
কৃষিমন্ত্রী প্রভু লাল সৈনির দাবি, দেশে মাটির উপরের জলের মাত্র ১.১৬% রাজস্থানে। মাটির নীচের জল ১.১%। জমিও অনুর্বর। তা সত্ত্বেও রাজস্থান কৃষিতে বরাবরই সমৃদ্ধ। জোয়ার-বাজরা-রাগির মতো মিলেট শস্য, ডাল, বার্লি, ইসবগুল, জিরে ইত্যাদি উৎপাদনে তারা প্রথম সারিতে। ৭০% মানুষ এখনও কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নতুন প্রজন্ম চায় অর্থকরী ফসল এবং তার দৌলতে মোটা মুনাফা। সেই কারণেই শুধু প্রথাগত কৃষিতে আটকে না-থেকে অলিভ, খেজুর ইত্যাদি চাষে জোর দিচ্ছেন তাঁরা। সরকারের তরফে দাবি, বাজরা চাষে যেখানে বছরে ১ লক্ষ টাকা রোজগার, সেখানে খেজুরে তা ৮-৯ লক্ষ। আয় মন্দ নয় অলিভ চাষেও। তার থেকে তৈরি তেল বাজারেও আসার কথা আগামী মাসে। ব্র্যান্ড-নাম ‘রাজ অলিভ’। স্বাস্থ্যকর হিসেবে দ্রুত চাহিদা বাড়ছে অলিভ থেকে তৈরি চায়ের মতো পানীয়েরও।
মরু রাজ্যে জলের আকাল। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রথম লক্ষ্য জলের যথোপযুক্ত ও যথাসম্ভব কম ব্যবহার। তাই তারা হাত ধরেছে ইজরায়েলি প্রযুক্তির। ব্যবহার করছে ড্রিপ-ইরিগেশন বা বিন্দু-সেচ। যেখানে পাশে পেতে রাখা পাইপ বেয়ে জল গাছের গোড়ায় যায় বিন্দু বিন্দু করে। প্রয়োজন অনুযায়ী। যাতে এক ফোঁটাও নষ্ট না-হয়। সারা দেশে জল নিয়ে হাহাকার যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এই বিন্দু-সেচই ভারতের ভবিষ্যৎ বলে সৈনিদের দাবি।
অনেক চাষের পক্ষেই রাজস্থানে প্রকৃতি বিরূপ। তাই প্রবল গরমের মধ্যেও চাষ বাঁচাতে একরের পর একর জুড়ে সার্কাসের মতো তাঁবু। সেখানে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা সবই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। পুরো ব্যবস্থাই প্রযুক্তির সুতোয় বাঁধা। সৈনির কথায়, ‘‘এই নতুন প্রযুক্তি নতুন প্রজন্মের পক্ষেই তাড়াতাড়ি আঁকড়ে ধরা সম্ভব। তাঁরা তা ধরছেনও।’’
রাজস্থানের কৃষি দফতরের কর্তারা বলছিলেন, আজকের প্রজন্ম ‘হাতে লাঙল তুলতে’ মূলত তিনটি জিনিস চায়— (১) উন্নত প্রযুক্তি (২) মোটা মুনাফা (৩) কম ঝুঁকি। তাঁদের দাবি, ভিন্ দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি মরু রাজ্যের খেতে বয়ে আনতে আজ অনেক দিনই চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি রাজস্থান সরকার। এখন বেশি করে চেষ্টা হচ্ছে বাকি দুই শর্ত পূরণেরও।
যেমন, মোটা মুনাফার জন্য অগ্রাধিকার পাচ্ছে অলিভ, খেজুর ইত্যাদির চাষ। লাভের গন্ধ আছে বলেই জমির ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে কড়াকড়ি তুলে দেওয়া হয়েছে অলিভ চাষে। আরও বেশি করে প্রাধান্য পাচ্ছে চুক্তি-চাষ। শুরুর ঠেলাটুকু দিতে রয়েছে ঢালাও ভর্তুকি। বিন্দু-সেচে ৯০% ও সূর্যালোক চালিত পাম্পে ৮৬% পর্যন্ত। প্রাথমিক লগ্নির ৬০-৭০ শতাংশও অনেক ক্ষেত্রে মেলে ভর্তুকি হিসেবে। এবং এ সবের জন্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পকেও পুরোদস্তুর কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে রাজ্যটি।
তেমনই আবার ঝুঁকি কমাতে ‘কাস্টম হায়ারিং সেন্টার’ গড়ায় উৎসাহ দিচ্ছে বসুন্ধরা রাজের সরকার। শুরুতেই ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারের মতো বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জাম না-কিনে, যাতে ওই সব কেন্দ্র থেকে প্রয়োজন অনুসারে সেগুলি ভাড়া নিতে পারেন চাষিরা। কোনও কারণে এক বছর চাষ মার খেলে যাতে কৃষকের মাথায় হাত না-পড়ে, সেই লক্ষ্যে জোর দেওয়া হচ্ছে পশুপালনে।
কৃষিমন্ত্রীর দাবি, তাঁরা এখন দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম দুধ উৎপাদনকারী। দিনে ৪.৮ লক্ষ কেজি। তা থেকে তৈরি লস্যি, পনির ইত্যাদি সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ে রফতানি করছে সরকারি ব্র্যান্ড ‘সরস’। চেষ্টা হচ্ছে উটের দুধের আইসক্রিম জনপ্রিয় করে তোলারও!
বসেরি গ্রামের ২৪ বছরের কমলেশ চৌধুরী দাবি করছিলেন, তাঁর তিন ভাই বিদেশে। কার্যত বাড়ির মতের বিপক্ষে গিয়ে নিজের জেদে চার বছর আগে চারটি খেতে স্রেফ শসার চাষ শুরু করেছিলেন তিনি। নতুন প্রজন্মের পাতে স্যালাডের চাহিদা দেখে। বছরে দু’বার ফলনের দৌলতে এখন বার্ষিক আয় ৪০ লক্ষ টাকা বলে তাঁর দাবি।
৯ থেকে ১১ নভেম্বর গ্লোবাল রাজস্থান এগ্রিটেক মিট (জিআরএএম বা গ্রাম) আয়োজন করছে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার রাজ্য। যেখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি আসবেন সাধারণ চাষিরা। লক্ষ্য প্রযুক্তি ও দক্ষতার আদান-প্রদান। এর দৌলতে আগামী দিনে আরও অনেক কমলেশ চৌধুরীর দেখা মিলবে বলেই সৈনিদের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy