সরকারের চার বছর পূর্তিতে সাফল্যের ঢাক পেটাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনার কথাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি করে বলেছেন নরেন্দ্র মোদী। দাবি করেছেন, এই এক প্রকল্পই দেশে আমূল বদলে দিচ্ছে আর্থ-সামাজিক সমীকরণ। এর দৌলতেই নাকি সারা দেশের গরিব মহিলাদের আশীর্বাদ পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই উজ্জ্বলার আওতায় সংযোগ নেওয়ার পরেও সিলিন্ডার কিনতে দমছুট গরিব পরিবারগুলি। কেউ তার দাম জোগাড় করতে হন্যে। আবার কেউ সে মুখো হচ্ছেন না সারা দিনের কাজ নষ্টের পরেও সিলিন্ডার হাতে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায়। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির যদিও দাবি, সংযোগের পাশাপাশি এই প্রকল্পে দ্রুত বাড়ছে সিলিন্ডার কেনার সংখ্যাও।
উজ্জ্বলায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ পেয়েছেন দেশে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা (বিপিএল) পরিবারের প্রায় চার কোটি মহিলা। কিন্তু প্রশ্ন হল, ক’জন তা নিয়মিত ব্যবহার করছেন? সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, অন্তত এ রাজ্যে সাধারণ গ্রাহকরা যেখানে বছরে গড়ে ৭-৮টি সিলিন্ডার কিনছেন, সেখানে উজ্জ্বলা গ্রাহকেরা কিনছেন মেরেকেটে চারটি।
কাঠ, খড়, কেরোসিনের মতো জ্বালানির দূষণ থেকে রেহাই দিতে ২০১৬ সালে প্রকল্পটি চালুর কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সাধারণ গ্যাস সংযোগের মতো বছরে ১২টি ভর্তুকির সিলিন্ডার ছাড়াও বাড়তি হিসেবে এর জন্য গোড়ার খরচ (১,৬০০ টাকা) ভর্তুকি হিসেবে জোগায় কেন্দ্র। ওভেন ও প্রথম সিলিন্ডারের দাম পরে প্রাপ্য ভর্তুকির টাকা থেকে কিস্তিতে মেটানোর সুযোগ থাকে। কেন্দ্রের দাবি, ২০২০ সালের মধ্যে সংযোগের লক্ষ্য ৫ কোটি থেকে বেড়ে হচ্ছে ৮ কোটি। কিন্তু এত সবের পরেও মাথাব্যথা পরে নিয়মিত সিলিন্ডার না কেনাই।
প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা
• দারিদ্র সীমার নীচে থাকা প্রতি পরিবারের এক জন মহিলা এই প্রকল্পের আওতায় গ্যাস সংযোগ পেতে পারেন।
• এখনও পর্যন্ত সারা দেশে এই প্রকল্পে গ্যাস নিয়েছেন প্রায় চার কোটি মহিলা। রাজ্যে ৫৩ লক্ষ জনেরও বেশি।
• দারিদ্র সীমার নীচে কারা (বিপিএল), এ ক্ষেত্রে তার বাছাই তালিকা তৈরি হয়েছে ২০১১ সালের আর্থ-সামাজিক জাতি সমীক্ষার (এসইসিসি) ভিত্তিতে।
• বিপিএল হলেও অনেকের নাম এসইসিসি তালিকায় নেই। তাই পরে শিথিল করা হয়েছে যোগ্যতার শর্ত।
• গোড়ায় সংযোগের জন্য গুনতে হওয়া ১,৬০০ টাকার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। গ্রাহককে তা দিতে হয় না।
• তবে কিনতে হয় ওভেন (দাম ১০০০ টাকা) এবং প্রথম সিলিন্ডার।
• তার টাকাও ঋণ হিসেবে দিচ্ছে তেল সংস্থা। পাওয়া যায় পরে প্রাপ্য ভর্তুকির টাকা জমিয়ে কিস্তিতে সেই ধার মেটানোর সুযোগও।
যেমন, এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫৩ লক্ষ মহিলা এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক ডিলারের দাবি, তাঁর মাত্র ২৫%-৩০% গ্রাহক নিয়মিত সিলিন্ডার কিনছেন। বাকিরা নন। ডিলার সংগঠনের কর্তা বিজনবিহারী বিশ্বাসের বক্তব্য, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আর্থিক সমস্যার জন্য অনেকেই সিলিন্ডার কিনতে সমস্যায় পড়ছেন।
অন্যদের মতো উজ্জ্বলা গ্রাহকেরাও ভর্তুকির সিলিন্ডার বাজার দরেই প্রথমে কেনেন। পরে ভর্তুকির টাকা জমা পড়ে অ্যাকাউন্টে। সে দিক থেকে দেখলে, ভর্তুকির টাকা সেই পেয়েই যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু অনেক গ্রাহক মানছেন যে, তাঁদের টানাটানির সংসারে ওই ভর্তুকি পরের সিলিন্ডার কেনার জন্য অ্যাকাউন্টেই ফেলে রাখা আর হয় না। ফলে প্রতিবারই সিলিন্ডার কিনতে গিয়ে দাম জোগাড় করা মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়।
হোঁচট যেখানে
• সংযোগের সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও, পরে নিয়মিত সিলিন্ডার কিনতে পারছেন না অনেকে।
• সাধারণ গ্রাহকেরা যেখানে বছরে গড়ে ৭-৮টি সিলিন্ডার কেনেন, সেখানে উজ্জ্বলা প্রকল্পে তা ৪টি।
• এ রাজ্যে কোনও কোনও জেলায় নিয়মিত গ্যাস কিনছেন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মহিলা।
• ভর্তুকির অঙ্ক পরে অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ঠিকই। কিন্তু শুরুতে সিলিন্ডারের টাকা জোগানোই সমস্যা অনেক গ্রাহকের।
• গ্রামাঞ্চলে আর এক সমস্যা কাছাকাছি গ্যাস সিলিন্ডার না পাওয়া। সমস্যা সারা দিনের কাজ শিকেয় তুলে সিলিন্ডারের অপেক্ষায় বসে থাকাও।
সমাধানে উদ্যোগ
• বাড়ির কাছে সিলিন্ডারের জোগান বাড়াতে আগ্রহী তেল সংস্থা। এই লক্ষ্যে দেশে ১০ হাজার নতুন ডিলার এ বছরই। তার মধ্যে ৬০০টির বেশি এই রাজ্যেই।
• ওভেন এবং প্রথম সিলিন্ডার ধারে কিনলে, তা শোধ করতে বাড়তি সময়। প্রথম ছ’টি সিলিন্ডারের ভর্তুকি জমিয়ে তা থেকে ওই ঋণের কিস্তি মেটানোর সুযোগ।
• ১৪.২ কেজির বদলে আগামী দিনে ভাবা হচ্ছে ৫ কেজির সিলিন্ডারের কথাও। শেষমেশ তা চালু হলে, দাম হিসেবে এক লপ্তে কম টাকা দিতে হবে গ্রাহককে।
এক গ্রাহক যেমন বলছিলেন, ‘‘গ্যাস নিয়েছি। কিন্তু সিলিন্ডারের যা দাম, তাতে এক বারে অত টাকা আমাদের মতো গরিব মানুষ কোথা থেকে বার করবে বলুন তো?’’ অনেকে আবার তাই বর্ষায় (যখন কাঠ জাতীয় জ্বালানি জোগাড় করা কঠিন) সিলিন্ডার কিনলেও, অন্য সময়ে তা কিনতে অত আগ্রহ দেখান না।
সঙ্গে রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সিলিন্ডার জোগানের সমস্যা। সাধারণত পরিকাঠামোর অভাবে হয় এলাকার একটি নির্দিষ্ট স্থানে ডিলারের কর্মী কিছু গ্রাহকের সিলিন্ডার এক সঙ্গে নিয়ে আসেন, নয়তো গ্রাহককেই দোকানে যেতে হয়। কিন্তু অনেক উজ্জ্বলা গ্রাহক একশো দিনের কাজের মতো দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। ফলে সিলিন্ডারের জন্য এক দিনের আয় হারানোর আশঙ্কা কাঁধে নিয়ে অপেক্ষা করে থাকা তাঁদের পোষায় না। ফলে সেই কাঠ ও কেরোসিনের যুগলবন্দিতেই ফেরেন তাঁরা।
তেল সংস্থাগুলির অবশ্য দাবি, এক বছরের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ৮৩% উজ্জ্বলা গ্রাহক সংযোগের পরে ফের সিলিন্ডার কিনেছেন। অনেকে বছরে ১০-১২টি সিলিন্ডারও কিনছেন। তবে সব মিলিয়ে যে গ্রাহক পিছু গড়ে ৪টি সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে, তা মানছে তারা। অনেকে সিলিন্ডার কিনে বিক্রি করেন বলেও অভিযোগ।
তেল সংস্থা সূত্রের খবর, উজ্জ্বলা গ্রাহকদের সুবিধার্থে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্র। দেশে এ বছর প্রায় ১০ হাজার নতুন ডিলার নিয়োগ করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৬০০টিরও বেশি এ রাজ্যে। সঙ্গে রয়েছে ওভেন ও প্রথম সিলিন্ডার ধারে কিনলে, ভর্তুকির টাকা জমিয়ে তা কিস্তিতে মেটানোর সুযোগও। রয়েছে ১৪.২ কেজির সিলিন্ডারের দামের হারে ৫ কেজির সিলিন্ডার আনার ভাবনাও।
আগামী বছর ভোট প্রচারে মোদীর সম্ভাব্য মোক্ষম অস্ত্র মেরামতে এখন তাই রাত জাগছে কেন্দ্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy