শেয়ার সূচক তুঙ্গে। সোনা সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে নেমে অনেকটাই নীচে। তেল তলানিতে। কিন্তু সুদ একদম নড়েনি। বহু দিন হল একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মাত্র দু’টি অক্ষর নিয়ে ছোট একটি শব্দ এটি। কিন্তু দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সুদের সামান্য পরিবর্তনে উত্তাল হতে পারে শেয়ার বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লগ্নির দুনিয়া।
সুদের সঙ্গে পণ্যমূল্যের সম্পর্ক অনেকটা যমজ সন্তানের মতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সঙ্গতি রেখে সুদও বাড়ে। কমলে সুদেও কমার প্রবণতা দেখা যায়। বহু দিন ধরে মূল্যবৃদ্ধি অত্যন্ত চড়া থাকায় সুদকেও আমরা নামতে দেখিনি। এই ব্যাপারে বিতর্ক চলছে গত দু’বছর ধরে। এক দিকে সরকার এবং শিল্প-বাণিজ্য মহল, অন্য দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কযারা অর্থের জোগান এবং সুদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে। গত দু’ বছর জাতীয় উত্পাদন ৫ শতাংশের আশেপাশে নেমে আসায় সুদ কমানোর সওয়াল তোলে শিল্প-বাণিজ্য মহল তো বটেই, এমনকী খোদ অর্থমন্ত্রীও। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি স্থায়ী ভাবে নেমে না-আসায় সুদও না- কমানোর সিদ্ধান্তে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনড় থাকে। এই নিয়ে অর্থমন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মধ্যে মনোমালিন্যও হয়।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, সুদ কমানো হলেই টাকার চাহিদা এবং জোগান বেড়ে উঠবে। ঘি পড়বে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে। গরিব মানুষেরা অত্যন্ত অসুবিধায় পড়বেন।
অন্য দিকে যাঁরা সুদ কমানোর দাবি তুলছেন তাঁদের বক্তব্য, সুদ বেশি থাকলে মূলধন সংগ্রহের খরচ বাড়ে, ফলে বাড়ে উত্পাদন খরচ। শিল্পপণ্যের দাম বাড়লেই কমে চাহিদা। ফলে কমাতে হয় উত্পাদন। হ্রাস পায় কর্মসংস্থান। দুর্বল হয়ে পড়ে অর্থনীতি। নেমে আসে জাতীয় উত্পাদন বৃদ্ধির হার। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, গাড়ি ও বাড়ির ঋণের উপর সুদ স্বাভাবিকের থেকে বেশি হলে কমে সেগুলির চাহিদা। ফলে শুধু এই দুই শিল্পই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদের উপর নির্ভরশীল আরও অনেক শিল্প যেমন ইস্পাত, সিমেন্ট, রং, টায়ার, ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যালস, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি শিল্প। ফলে কর্মসংস্থানও কমতে পারে ভাল রকম। অর্থাত্ দেখা যাচ্ছে, দু’পক্ষের যুক্তিই সমান জোরালো।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি পাকাপাকি কমলে তবেই সুদ কমানোর কথা বিবেচনা করা হবে।
পরিস্থিতি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তাতে মনে হয়, আমরা ধীরে ধীরে কম সুদের জমানাতেই প্রবেশ করতে চলেছি। পাইকারি ও খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার এখন নিম্নমুখী। বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম তলানিতে ঠেকায় দফায় দফায় কমানো হচ্ছে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম। এর জেরে মূল্যবৃদ্ধির হারে আরও পতন আশা করা যায়। পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ন নজর রাখছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। দাম কমার এই প্রবণতা জারি থাকলে আশা করা যায়, আগামী দিনে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও রেপো রেট কমানোর কথা বিবেচনা করবে। রেপো রেট হল যে-সুদের হারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা ধার দেয়। এ ছাড়া বিবেচনা করা হতে পারে নগদ জমার অনুপাত (সিআরআর) কমানোর কথাও।
সুদ যদি সামান্যও কমানো হয়, তা হলে শিল্প-বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের উপরে তার প্রতিক্রিয়া হবে বিশাল। কী কী? তা দেখে নেব এক নজরে।
• ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড় সব শিল্পেই সুদ বাবদ খরচ কমবে। ফলে কমবে উত্পাদন খরচ। বাড়বে পণ্য-চাহিদা।
• তাত্ক্ষণিক ভাবে ভাল রকম বাড়বে শেয়ার সূচক। বিশেষত বাড়বে ব্যাঙ্ক এবং বড় আকারে ঋণনির্ভর শিল্পের বিভিন্ন শেয়ারের বাজারদর।
• বাড়ি ও গাড়ির ঋণে সুদ কমবে। ফলে বাড়বে চাহিদা এবং কর্মসংস্থান। উপকৃত হবে আরও অনেক শিল্প।
• সুদ কমলে বাড়বে বন্ডের বাজারদর। ফলে বেড়ে উঠবে বিভিন্ন বন্ড এবং ইনকাম ফান্ডের নিট অ্যাসেট ভ্যালু।
• ব্যাঙ্ক আমানত এবং অন্যান্য জমায় সুদ কমবে। স্থির আয় প্রকল্পে যাঁরা টাকা রাখতে চান, তাঁরা সুদ কমার আগেই দীর্ঘ মেয়াদে টাকা জমা করলে লাভবান হবেন।
• বিভিন্ন শিল্পে উত্পাদন বাড়লে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হলে জাতীয় উত্পাদন বাড়ার ভাল সম্ভাবনা দেখা দেবে। জাতীয় উত্পাদন বাড়লে কমবেশি সবাই উপকৃত হবেন।
• শিল্পে রুগণ্তা কমে উত্পাদনে গতি আসবে। ব্যাঙ্কগুলির অনুত্পাদক সম্পদের বোঝা কমবে। ভারতের ক্রেডিট রেটিং বাড়ার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হবে। সবাই তাই অধীর অপেক্ষায়, কবে সুদ কমে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy