বাইপাসে ইস্পাত প্রগতি ভবনের উদ্বোধনে সজ্জন জিন্দল। সঙ্গে ইন্সড্যাগ-এর ডিরেক্টর জেনারেল সুষীম বন্দ্যোপাধ্যায় (মাঝে) ও অপর কর্মকর্তা ধ্রুব ভাদুড়ি। নিজস্ব চিত্র
রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং প্রশাসনিক গড়িমসি। সঙ্গে কয়লা ও আকরিক লোহা জোগানের সমস্যা এবং ইস্পাতের চাহিদায় ভাটা। সব মিলিয়ে লগ্নির রাস্তা জুড়ে দাঁড়ানো জগদ্দল পাথরে আটকে গেল রাজ্যে জিন্দলদের শালবনি ইস্পাত প্রকল্প।
রবিবার কলকাতায় ইনস্টিটিউট ফর স্টিল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গ্রোথ (ইন্সড্যাগ)-এর নতুন দফতর ইস্পাত প্রগতি ভবনের উদ্বোধনে এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকল্প স্থগিত রাখার কথা জানান জেএসডব্লিউ স্টিলের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সজ্জন জিন্দল। তিনি বলেন, “শালবনির প্রকল্পটি আমরা স্থগিত রাখলাম। কারণ কয়লা ও আকরিক লোহা, এই দুই কাঁচামাল না-পাওয়া গেলে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই সমস্যার।” শিল্পমহলের একাংশ মনে করছে, ইস্পাতের পড়তি চাহিদাও এ ধরনের প্রকল্পে আগ্রহ কমার কারণ।
জিন্দলের দাবি, ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এই ইস্পাত প্রকল্পে তাঁরা ৭০০ কোটি টাকা ঢেলেছেন। কিন্তু কাঁচামাল পাওয়াই যেখানে এত অনিশ্চিত, সেখানে প্রকল্পটি নিয়ে আরও এগোনো সংস্থার পক্ষে যুক্তিযুক্ত হবে না বলেই অভিমত তাঁর। কারণ এমনিতেই ইস্পাত কারখানার কাজ শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় আকরিক লোহার জোগান এখনও নিশ্চিত করা যায়নি সেখানে। তার উপর সুপ্রিম কোর্ট ২১৪টি কয়লা খনি বণ্টন বাতিলের নির্দেশ দেওয়ায় খারিজ হয়েছে রাজ্যে তাঁদের তিনটি কয়লা ব্লকও। প্রস্তাবিত প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সেগুলি রাজ্য সরকারের এজেন্সির মাধ্যমেই পেয়েছিল তারা। ফলে এই মুহূর্তে শালবনিতে প্রকল্প চালুর জন্য জেএসডব্লিউ বেঙ্গলের হাতে না-আছে কয়লা, না-আছে আকরিক লোহার জোগান। সজ্জনের অবশ্য দাবি, আসন্ন খনি নিলামে ওই তিনটি ব্লকের জন্য তাঁরা দরপত্র দেবেন।
তবে শুধুমাত্র কাঁচামালের জোগানের অভাবই যে-রাজ্যে জিন্দলদের বিনিয়োগ বাস্তবায়িত করার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয়। এ দিন লগ্নি স্থগিত রাখতে বাধ্য হওয়ার জন্য নাম না-করে ঠারেঠোরে রাজ্য সরকারকেও দায়ী করেছেন সজ্জন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, শালবনিতে যে-বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ার কথা ছিল, খনি হাতে থাকাকালীন তা কেন চালু করেননি তাঁরা? তিনি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন, সরকারি বাধা-নিষেধের কারণেই তা সম্ভব হয়নি।
বস্তুত, এর আগেই জিন্দল গোষ্ঠী জানিয়েছিল, শালবনিতে সংস্থার তৈরি বিদ্যুৎ কেনার প্রতিশ্রুতি রাজ্য দিলে প্রকল্প দ্রুত শুরু করতে রাজি তারা। তারা চেয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের ওই প্রকল্পে প্রথমে অন্তত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালুর জন্য এই সহযোগিতাটুকু করুক রাজ্য। সেখানে তৈরি বিদ্যুৎ কেনার আশ্বাস দিয়ে নতুন করে সই করুক চুক্তিপত্র (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট)। কিন্তু সেই প্রস্তাবে নারাজ বিদ্যুৎ দফতরের বক্তব্য ছিল, ওই বিদ্যুৎ বরং বাণিজ্যিক ভাবে অন্যত্র বিক্রি করুক জিন্দলরা।
কয়লা ব্লক জিততে পারলে জিন্দলরা ফের রাজ্যে প্রকল্প গড়তে এগিয়ে আসবেন কি না, সেই প্রশ্নও করা হয় সজ্জনকে। তাঁর জবাব, তখন সব কিছুই নতুন করে খতিয়ে দেখবেন তাঁরা। যদিও পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়ার আশা ও আগ্রহ, দু’টোই তাঁদের আছে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, প্রথম পর্যায়ে ৩০ লক্ষ টনের ইস্পাত কারখানা এবং সেখানে ব্যবহারের জন্য ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে বাম জমানায় শালবনিতে ২০ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব দিয়েছিল জিন্দল গোষ্ঠী। যা এখনও চালু না-হওয়ায় কিছু দিন আগে তাদের দিকে তোপও দেগেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সংস্থার দাবি ছিল, প্রকল্প তৈরিতে তারা দায়বদ্ধ হলেও আকরিক লোহার জোগান নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ঋণ দিচ্ছে না ব্যাঙ্কগুলি। উল্লেখ্য, ‘গ্রিনফিল্ড’ বা সম্পূর্ণ নতুন ইস্পাত প্রকল্পে সরকার বা সরকারি সংস্থার মাধ্যমে আকরিক লোহা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না-হলে, ধার দেয় না কোনও ব্যাঙ্ক।
এই পরিস্থিতিতে মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব ছিল, আপাতত না-হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গড়ুন জিন্দলরা। কিন্তু ওই কেন্দ্র গড়ার কথা ছিল সংস্থার ইস্পাত কারখানার নিজস্ব ব্যবহারের জন্য। চুক্তিও হয়েছিল সেই অনুযায়ী। ফলে কারখানার আগে তা চালু হলে, সেই বিদ্যুৎ বাইরে বেচতে হবে সংস্থাটিকে। তার জন্য সংশোধন করতে হবে রাজ্যের সঙ্গে চুক্তিও।
জেএসডব্লিউ বেঙ্গলের কর্তা বিশ্বদীপ গুপ্ত এ দিন বলেন, “ইস্পাত প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব ছিল। তাই তা বাইরে বিক্রি করতে হলে চুক্তি সংশোধন করতে হত। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই ছাড়পত্র দেয়নি। নিজেও ওই বিদ্যুৎ কিনে নিতে রাজি হয়নি।”
রবিবার সজ্জন জানান, তাঁরা গোয়ার কাছে এক বন্দর থেকে কর্নাটকের বেল্লারিতে সংস্থার বিজয়নগর ইস্পাত কারখানায় আকরিক লোহা সরবরাহের জন্য ৫০০ কিলোমিটারের পাইপলাইন তৈরি করছেন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গে কেন এই কৌশল নেওয়া হল না। উত্তরে তিনি বলেন, “বিজয়নগরের অনুকরণ করা যাবে না এ রাজ্যে। কারণ, প্রথমত ওটা সম্প্রসারণ প্রকল্প। দ্বিতীয়ত, ওখানে অন্তত ৫০% আকরিক লোহার নিশ্চিত জোগান রয়েছে।”
প্রসঙ্গত, ২০০৭-এ রাজ্য ও জিন্দল গোষ্ঠীর মধ্যে চুক্তি সইয়ের পরে প্রকল্পটি বারে বারে বাধার মুখে পড়ে। ২০০৮-এ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শিলান্যাসের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে প্রকল্পের অদূরেই মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা। ২০০৯-এ মন্দার কারণে তৈরি হয় আর্থিক সমস্যা। মন্দা ও ইস্পাতের পড়তি চাহিদায় ব্যাঙ্কঋণ পাওয়া কঠিন হয়। এর পর তৈরি হয় জমি-জটিলতা। প্রয়োজন ছিল ৪৩৩৪ একর। ২৯৪ একর সরাসরি কেনে সংস্থা। জমির ঊধ্বর্র্সীমা আইন অনুযায়ী শিল্পের জন্য বাড়তি জমি রাখতে ১৪ ওয়াই ধারায় আবেদন করতে হয়। এই আবেদন করে অতিরিক্ত জমি রাখার জন্য ভূমি দফতরের অনুমোদন নিতে হয়। ২৯৪ একর কেনার আগে সংস্থা অনুমোদন না-নেওয়ায় জমির লিজ চুক্তি আটকে যায়। শিল্প দফতরের হস্তক্ষেপে সে সমস্যা অবশ্য পরে মেটে।
তবে এ দিন প্রকল্প স্থগিত রাখার ঘোষণায় আসলে গোটা প্রকল্পটাই হিমঘরে চলে গেল কি না, এখন সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে শিল্পমহল জুড়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy