গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভোটপ্রচারের শেষবেলায় ভিডিয়ো বার্তায় তেলঙ্গানাবাসীর কাছে কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী মনে করিয়ে দিয়েছেন, এক দশক আগে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে নতুন রাজ্য গঠনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাঁর দলই করেছিল। তেলঙ্গনাবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘আপনারা আমাকে ‘সনিয়া আম্মা’ যে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছেন, তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’’
ইতিহাস বলছে, সনিয়ার দাবিতে সত্যতা রয়েছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে অখণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে নয়া রাজ্য গড়ার যে বিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার পাশ করেছিল, তার নেপথ্যে ছিল সে সময়কার কংগ্রেস সভানেত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আবার সেই ইতিহাসই মনে করিয়ে দিচ্ছে, তার আগের দেড় দশক ধরে তেলঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে কলভাকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাওয়ের (‘কেসিআর’ নামেই যিনি সমধিক পরিচিত) ধারাবাহিক আন্দোলনের কথা। ঘটনাচক্রে, তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কেসিআরের দল ‘ভারত রাষ্ট্র সমিতি’ (বিআরএস)-র সঙ্গে এ বারও ভোটে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা কংগ্রেসের।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তেলঙ্গানা গড়ার কৃতিত্ব দাবি করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটেও কেসিআরের বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিল কংগ্রেস। কিন্তু দু’বারই তাদের পর্যুদস্ত হতে হয়েছিল। এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি হলে টানা তিন বার হায়দরাবাদের কুর্সিতে বসবেন কেসিআর। কিংবদন্তি তেলুগু অভিনেতা তথা তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এনটি রামা রাও-ও যে সাফল্যের মুখ দেখেননি। ভোটের তেলঙ্গানায় এখন নানা ইস্যুর সঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্নও। বিবিধ জনমত সমীক্ষায় ‘ত্রিশঙ্কু বিধানসভা’র পূর্বাভাস সঙ্গী করেই বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। ফল জানা যাবে আগামী ৩ ডিসেম্বর ইতিমধ্যেই ভোট হয়ে যাওয়া চার রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান এবং মিজ়োরামের সঙ্গে।
ভারতে ভোটের ইতিহাস অবশ্য বলছে, আসল ফলের সঙ্গে জনমত সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষা অনেক সময়েই মেলে না। তবে ফলাফল মিলে যাওয়ার উদাহরণও আছে। এবিপি নিউজ-সি ভোটারের সর্বশেষ জনমত সমীক্ষা পূর্বাভাস দিয়েছে, জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’ করতে পারেন কেসিআর। তাঁর দল ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৯ থেকে ৬১টি আসনে জয়ী হতে পারে। কংগ্রেসের ঝুলিতে যেতে পারে ৩৯ শতাংশ ভোট। তারা জিততে পারে ৪৩ থেকে ৫৫টি আসনে। ১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫ থেকে ১১টি আসনে বিজেপি প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেন বলে ওই সমীক্ষার পূর্বাভাস। অন্য দিকে, নির্দল ও অন্য দলগুলির প্রার্থীরা সামগ্রিক ভাবে ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪ থেকে ১১টি আসনে জিততে পারেন।
১১৯ আসনের তেলঙ্গানা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ৬০। ভোট পণ্ডিতদের একাংশ মনে করছেন, কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ‘নির্ণায়ক’ হয়ে উঠতে পারে বিজেপি এবং ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর প্রধান তথা হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসির ‘ভূমিকা’। সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন কেসিআর।
তেলঙ্গানায় এ বার মোট ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ২৬ লক্ষ। প্রার্থীর সংখ্যা ২,২২০। শাসক শিবিরের উল্লেখযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর (গজওয়েল ও কাম্মারেড্ডি), তাঁর ভাইপো তথা মন্ত্রী হরিশ রাও (সিদ্দিপেট) এবং পুত্র তথা মন্ত্রী কে টি রামারাও (সিরসিল্লা)। কাম্মারেড্ডি আসনে কেসিআরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ রেবন্ত রেড্ডি। আর এক ওজনদার কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি উত্তমকুমার রেড্ডি লড়ছেন হুজুরনগরে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মহম্মদ আজহারউদ্দিন প্রার্থী হয়েছেন সেকেন্দ্রাবাদের জুবিলি হিলস কেন্দ্রে। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বান্দি সঞ্জয় কুমার করিমনগর আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
শাসক দল বিআরএস এ বার ১১৯টি আসনেই প্রার্থী দিলেও কংগ্রেস লড়ছে ১১৮টি আসনে। একটি আসন বাম দল সিপিআইকে ছেড়েছে তারা। যদিও কংগ্রেস দাবিমতো তিনটি আসন না ছাড়ায় রাজ্যের মোট ২৪টি আসনে আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। দলের তেলঙ্গানা রাজ্য সম্পাদক তাম্মিনেনি বীরভদ্রমের অভিযোগ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের মতো দাক্ষিণাত্যের ওই রাজ্যেও ‘ইন্ডিয়া’র শরিক দলগুলির প্রতি কংগ্রেসের ভূমিকা ‘নমনীয়’ নয়।
অন্য দিকে, আর এক বিরোধী দল বিজেপি প্রার্থী দিয়েছে ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রে। আটটি আসন তারা ছেড়েছে জনপ্রিয় তেলুগু অভিনেতা পবন কল্যাণের দল জনসেনাকে। পবনের ‘রাজনৈতিক সক্রিয়তা’ মূলত অন্ধ্রেই সীমাবদ্ধ। তবে দু’রাজ্যেই বসবাসকারী অনগ্রসর কাপু জনগোষ্ঠীর উপর তাঁর প্রভাব রয়েছে। গত ৫ অক্টোবর পবন এনডিএ ছাড়ার কথা ঘোষণা করে জানিয়েছিলেন, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেসকে হারানোর জন্য আগামী বিধানসভা ভোটে (লোকসভার সঙ্গেই অন্ধ্রে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা) চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপির সঙ্গে জনসেনা আসন সমঝোতা করবেন তিনি। কিন্তু তার এক মাস পরেই তেলঙ্গানায় মোদীর মঞ্চে দেখা যায় তাঁকে! পবনের দাদা চিরঞ্জীবীও তেলুগু চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা। ২০০৯-এ ভোটের ঠিক আগে নিজের দল প্রজারাজ্যম পার্টি গড়ে অবিভক্ত অন্ধ্রের বিধায়ক হয়েছিলেন তিনি। পরে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। তবে বর্তমানে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন চিরঞ্জীবী।
২০১৮-র বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী কেসিআরের দল তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা টিআরএস ৮৮টি আসনে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এ বার সেই দলের নাম বদলে হয়েছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। এ ছাড়া কংগ্রেস ১৯ এবং তার সহযোগী টিডিপি দু’টি আসনে জিতেছিল। ওয়েইসির মিম ৭, বিজেপি ১ এবং অন্যেরা জিতেছিল ৪টিতে। টিআরএস প্রায় ৪৭, কংগ্রেস ২৮, টিডিপি সাড়ে ৩ এবং বিজেপি প্রায় ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। দক্ষিণ তেলঙ্গানার মেহবুবনগর, নলগোন্ডা এবং নগরকুর্নুলের মতো জেলাগুলিতে টিআরএসের সঙ্গে কিছুটা টক্কর দিলেও রাজধানী হায়দরাবাদ এবং মধ্য ও উত্তর তেলঙ্গানায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল কংগ্রেস-টিডিপি-সিপিআই-তেলঙ্গানা জন সমিতির জোট ‘মহাকুটুমি’। এ বার তেলঙ্গানার ভোটে টিডিপি লড়ছে না। চন্দ্রবাবু জাতীয় স্তরেও কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছেন।
ওই বিধানসভা ভোটের ছ’মাসের মধ্যেই অবশ্য তেলঙ্গানার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গিয়েছিল। কংগ্রেসকে পিছনে ঠেলে দু’নম্বরে উঠে এসেছিল বিজেপি। সে রাজ্যের ১৭টি লোকসভা আসনের মধ্যে তারা জিতেছিল চারটিতে। কংগ্রেস তিনটি। মুখ্যমন্ত্রী কেসিআরের দল ন’টি এবং মিম একটিতে জয়ী হয়েছিল। তার পরের বছর হায়দরাবাদ পুরসভা ভোটেও বজায় ছিল বিজেপির অগ্রগতি। চার থেকে বেড়ে তাদের কাউন্সিলর সংখ্যা হয় ৪৮! দেড়শো আসনের পুরসভায় ৫৫টিতে জিতে কোনওমতে মিমের সমর্থনে বোর্ড দখল করে কেসিআরের দল।
এ বারও বিধানসভা ভোটের আগেই মিম প্রধান আসাদউদ্দিন জানিয়ে দিয়েছেন, যেখানে তাঁদের প্রার্থী নেই সেখানে বিআরএস প্রার্থীদের সমর্থন করা হবে। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে প্রচারের শেষপর্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও শাসক বিআরএসের তুলনায় বিরোধী কংগ্রেসের সমালোচনাতেই বেশি সময় ব্যয় করেছেন। তবে ভোটের আঁচ বলছে, শেষবেলায় ‘ত্রিমুখী’ তেলঙ্গানা ধীরে ধীরে মোড় নিচ্ছে বিআরএস বনাম কংগ্রেস আড়াআড়ি লড়াইয়ে। গত কয়েক মাসে বিজেপি এবং বিআরএস ছেড়ে একাধিক নেতা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। বিজেপির ইস্তাহার কমিটির চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন সাংসদ জি বিবেকানন্দ বেঙ্কটস্বামী ওরফে বিবেক, প্রাক্তন মন্ত্রী তথা পাঁচ বারের বিজেপি বিধায়ক এ চন্দ্রশেখর, প্রাক্তন সাংসদ কে রাজগোপাল রেড্ডি, বিআরএসের প্রভাবশালী বিধান পরিষদ সদস্য কাশীরেড্ডি নারায়ণ রেড্ডি, ঠাকুর বালাজি সিংহ, বিদায়ী বিধায়ক ভিএম আব্রাহাম, ‘লেডি অমিতাভ’ নামে পরিচিত অভিনেত্রী-রাজনীতিক বিজয়শান্তি এমনকি, হায়দরাবাদের নিজাম পরিবারের উত্তরসূরি নবাব মির নজফ আলি খানও সেই তালিকায় রয়েছেন।
ভোটমুখী অন্য রাজ্যগুলির মতোই তেলঙ্গানাতেও এ বার একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে লড়াইয়ে নেমেছে কংগ্রেস। অসুস্থ অবস্থাতেও সে রাজ্যে প্রচারে গিয়ে সনিয়া জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের ধাঁচে তেলঙ্গানার প্রতি পরিবারের গৃহকর্ত্রী পাবেন মাসে আড়াই হাজার টাকা। সরকারি বাসে মহিলাদের বিনা পয়সায় সফর, ৫০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, পরিবারপিছু ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ, গৃহহীনদের বিনামূল্যে জমি এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান, ‘রাজীব আরোগ্যশ্রী’ প্রকল্পে ১০ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা, কৃষকদের ১৫ হাজার টাকা বার্ষিক অর্থসাহায্য, পড়ুয়াদের পাঁচ লক্ষ টাকার ‘বিদ্যা ভরসা কার্ড’ দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি।
অন্য দিকে, কেসিআরের ‘হাতিয়ার’ গত ১০ বছরের নানা জনমুখী কর্মসূচি। আর তার প্রথমেই রয়েছে কৃষকদের জন্য ‘রায়তু বন্ধু যোজনা’। ওই প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে প্রতি একর শস্য পিছু বছরে ১০ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হয়। তা দেওয়ার কথা বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ জানুয়ারিতে। কিন্তু ২০১৮ সালে এই নভেম্বর মাসেই বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে কৃষিজীবী ভোটারদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়েছিল কেসিআর সরকার। এ বার কংগ্রেসের অভিযোগের ভিত্তিতে তা বন্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। বিআরএস নেতৃত্ব ভোটের প্রচারে বিষয়টিকে ‘অস্ত্র’ করেছেন। সরাসরি ‘কৃষকবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করছেন রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গেদের।
এ বারের বিধানসভা ভোটে ‘দলিতবন্ধু যোজনা’ও শাসকদলের বড় ‘অস্ত্র’। প্রতিটি দলিত পরিবারকে বাড়ি তৈরির জন্য এককালীন ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার এই প্রকল্প ভোটের বাজারে সুফল দেবে বলে বিআরএস নেতৃত্বের দাবি। যদিও ওই প্রকল্প ঘিরে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। তবে প্রতিশ্রুতি বা উন্নয়নের ফিরিস্তি নয়, তেলুগু রাজনীতির পুরনো অঙ্ক মেনেই শেষপর্বে ‘টাকা ছড়ানোর’ উপরেই বহু আসনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে বলে মনে করছেন যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীদের একাংশ।