CM Mamata Banerjee on West Bengal Police

মমতা পুলিশে কোন লবির কথা বলেছেন? কী সেই লবি? কারা আছেন? হদিস আনন্দবাজার অনলাইনে

উত্তরবঙ্গে কর্মরত এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, সকলেই সব জানেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেন না। কারণ, লবি ‘ক্ষমতাধর’। কিন্তু এখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী লবির কথা সর্বসমক্ষে বলে দিয়েছেন।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:২৭
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

মৌচাকে ঢিল ছুড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মৌচাকের নাম রাজ্য পুলিশ। মৌচাক থাকলে তাতে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ থাকবে। যার নাম ‘লবি’। মৌচাক থাকলে মধুও থাকবে। সেই ‘মধু’ হল ‘ট্রান্সফার-পোস্টিং’।

Advertisement

রাজ্য পুলিশে যে ‘লবি’ কাজ করে, বাহিনীর অন্দরে তা অজানা ছিল না। বৃহস্পতিবার সেই শব্দটিকেই প্রকাশ্যে এনে ফেলেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। নবান্ন সভাঘরের প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বলেছেন, ‘‘এক এক জনের এক এক রকম পুলিশপ্রীতি। অনেক সৎ পুলিশ অফিসার আছে, যারা খেটে খায়। তাদের দিকে তোমরা নজর দাও না। লবি চলে! লবি! এই লোকটা আমার বন্ধু, একে প্রোমোশন দিতে হবে। ওই লোকটা আমার পরিচিত, ওকে আগে নিয়ে আসতে হবে। কেন? কিসের জন্য? যে কাজের লোক হবে, তাকে দিতে হবে। কোনও লবি চলবে না। লবি একটাই— মানুষের।’’

লবি প্রসঙ্গে বলার সময় বৈঠকে হাজির রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যা থেকে বাহিনীর অনেকে মনে করছেন, রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশকের উদ্দেশেই মমতা ওই কথা বলেছেন। তা মেনে নিয়েও অবশ্য অনেকে বলছেন, রাজ্য পুলিশ নিয়ে কথা বলতে গেলে বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসারকেই বলতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর উপর ‘আস্থা’ হারিয়ে ফেলেছেন। বস্তুত, কর্মদক্ষতার নিরিখে রাজীব সারা দেশে প্রথম পাঁচ জন আইপিএসের মধ্যে অনায়াসে স্থান পাবেন বলে প্রশাসনে তাঁর সতীর্থদের বড় অংশের অভিমত। তবে অন্য এক পক্ষ আবার মনে করেন, নজরদারির ক্ষেত্রে প্রায় অবিসংবাদী দক্ষতা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে রাজীবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কম। তবে তিনি যখনই যে প্রশাসকের অধীনে কাজ করেছেন, তখনই সংশ্লিষ্ট প্রশাসক তাঁর উপর আস্থা রেখেছেন। মমতাও তার ব্যতিক্রম নন।

Advertisement

তবে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশে লবি সংক্রান্ত বক্তব্য রাজ্যের পুলিশবাহিনীতে কার্যত ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের নিচু থেকে উপরতলার বড় অংশ মমতার ওই বক্তব্যে সন্তুষ্ট বলেই জানা যাচ্ছে। ওই অংশ মনে করছে, মুখ্যমন্ত্রী ‘সত্যি’ তুলে ধরেছেন। তাঁর এই মন্তব্যে স্পষ্ট, পুলিশমন্ত্রী হিসেবে সমস্ত কিছুই তাঁর নজরে রয়েছে। তিনি সব খবরই রাখেন। পুলিশবাহিনীর অন্দরে কোথায় কী ঘটছে, সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী সম্যক অবহিত। এক প্রবীণ অফিসারের কথায়, ‘‘ওঁকে যিনিই ব্রিফ করে থাকুন, একেবারে ঠিকঠাক ব্রিফ করেছেন!’’

বাহিনীর একটি বড় অংশের দাবি, উচ্চ স্তরের পুলিশকর্তারাই বাহিনীর অন্দরে ‘লবি’কে প্রশ্রয় দেন। তাঁরাই লবি সামলান এবং লবির লোকজনকে চালনা করেন। উত্তরবঙ্গে কর্মরত এক পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, সকলেই সব জানেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেন না। কারণ, লবি ‘ক্ষমতাধর’। কিন্তু এখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী লবির কথা সর্বসমক্ষে বলে দিয়েছেন। তা-ই যাঁরা ‘ভুক্তভোগী’, তাঁরা অন্তত একান্ত আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে পারছেন। যেমন উত্তরবঙ্গের ওই আধিকারিকের দাবি, সম্প্রতি রাজ্য জুড়ে ‘ইনস্পেক্টর’ পদমর্যাদার আধিকারিক পর্যায়ে বড়সড় রদবদল হয়েছে। নবান্ন থেকে রদবদলের সেই তালিকা প্রকাশের পরেই বাহিনীতে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। বিক্ষুব্ধদের বক্তব্য ছিল, ‘যোগ্যদের’ বাদ দিয়ে ‘অযোগ্যদের’ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

রাজ্য পুলিশের একাধিক সূত্রের দাবি, অভিযোগ আরও রয়েছে। ২০০৯ সালে যাঁরা সাব ইনস্পেক্টর পদে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে ইনস্পেক্টর হয়েছেন ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ২০১০ ব্যাচের সাব ইনস্পেক্টরেরা গত বছরের পুজোর আগে ইনস্পেক্টর হয়েছেন। কিন্তু সাব ইনস্পেক্টর থাকাকালীন যাঁরা কখনও কোনও থানায় ওসির দায়িত্ব সামলাননি, তাঁদের অনেককে দেখা গিয়েছে ওই তালিকায় ‘আইসি’ হিসাবে বড় বড় থানার দায়িত্ব পেতে। এ নিয়ে বাহিনীর অন্দরে প্রশ্নও তৈরি হয়েছিল। তবে শুধু ইনস্পেক্টর নয়, আইজি, ডিআইজি বা এডিজি স্তরের পুলিশকর্তাদের পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও লবি হয় বলে বাহিনীর অনেকের দাবি।

একাধিক পুলিশকর্তার মতে, মুখ্যমন্ত্রী কোনও না কোনও ভাবে লবির বিষয়টি জানতে পেরেছেন। সে কারণেই ইনস্পেক্টরদের রদবদলের তালিকা প্রকাশের পরের প্রথম প্রশাসনিক বৈঠকেই বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ‘কড়া বার্তা’ দিতে চেয়েছেন। এক দিকে যেমন বাহিনীর কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন যে, পুলিশমন্ত্রী হিসাবে তিনি সব খবর রাখেন, তেমনই যাঁরা লবি করেন, তাঁদেরও সরাসরি সতর্ক করেছেন।

পুলিশের মতো একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনীতে কেন লবি থাকবে, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কর্তব্যরত বিভিন্ন স্তরের অফিসারদের বক্তব্য, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশবাহিনীতেও ‘তাঁবেদার সংস্কৃতি’ চালু হয়েছে। চালু হয়েছে অন্যের চোখ দিয়ে বা কান দিয়ে দেখার অভ্যাস। যার ‘শিকার’ হতে হচ্ছে ‘যোগ্য’ আধিকারিক এবং কর্মীদের অনেককে। তবে এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘একে লবি না-বলে শীর্ষ স্তরের ‘গ্রুপ’ বলাই ভাল। তাঁরা যা বলছেন, সেটাই সত্যি হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাহিনীর একটা অংশের কর্মীদের দ্রুত পদোন্নতি হচ্ছে। ‘কাছের লোক’ কি না দেখে পোস্টিং হচ্ছে।’’

এই তাঁবেদার কারা? স্বভাবতই এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। তবে অনেকের ইঙ্গিত, পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ মহলে যাঁদের অবাধ যাতায়াত রয়েছে, তাঁরাই এই ভূমিকায় রয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নাড়াচাড়া পড়েছে বাহিনীর সদস্যদের পুরস্কৃত করার বিষয়টিও। ‘অসাধারণ এবং প্রশংসনীয়’ কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়ার রেওয়াজ আছে পুলিশে। বাহিনীর একটি অংশের দাবি, কারা পুরস্কার পাবেন, তা-ও ঠিক হয় লবির জোরেই। পুলিশকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, আগে এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তালিকা পাঠানো হত। এখন তালিকা প্রকাশ করা হয় না। পুরস্কার পাওয়ার সময় জানা যায়, কারা পুরস্কৃত হচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে ট্র্যাফিক বা কোস্টাল বিভাগে কর্মরত কর্তাদের পুরস্কার দেওয়া নিয়েও। ২০২১ সালে মমতা তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এমন কয়েক জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যাঁরা একটা সময়ে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ ছিলেন বা ‘সাসপেন্ড’ ছিলেন। বিরোধী শিবিরের এক নেতার একদা ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত এক পুলিশকর্তাও পুরস্কার পেয়েছেন। যে ঘটনার পরে কটাক্ষ করে বাহিনীর এক পদস্থ অফিসার বলেছিলেন, ‘‘মনে হয়, সরকার-বিরোধী কাজের জন্যই এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে!’’ কেউ কেউ বিষয়টিকে ‘দৃষ্টিকটু’ বলেও ব্যাখ্যা করেছেন। তবে পাশাপাশিই অনেকে বলেছেন, কে, কখন ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ ছিলেন বা নিলম্বিত ছিলেন, তা দিয়ে তাঁর পুরো কর্মজীবনকে দেখা পেশাদারিত্ব হতে পারে না। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘দৃষ্টিকটু লাগা তো দূরস্থান, পুরস্কারের ক্ষেত্রে মনোনয়ন এটাই প্রমাণ করে যে, এর মধ্যে কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই। একদা বিরোধী শিবিরের নেতার ঘনিষ্ঠ অফিসারও যোগ্য হলে পুরস্কৃত হতে পারেন। সেটাও একটা দৃষ্টান্ত বৈকি।’’

বাহিনীর অন্দরে এই জল্পনা এবং আলোচনায় স্পষ্ট যে, নবান্নের বৈঠকে পুলিশে লবির কথা প্রকাশ্যে বলে মমতা বাহিনীর বড় অংশের ‘বিশ্বাস এবং আস্থা’ অর্জন করেছেন, যা আগামী বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর কাছে জরুরি। রাজ্যের সীমান্তবর্তী এক জেলায় কর্মরত এক আধিকারিকের মতে, রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে সামনে রেখে যে ভঙ্গিমায় মমতা গোটা বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছেন, তাতে নিচু এবং উপরতলার পুলিশকর্মীরা খুশি। তাঁরা বুঝেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কানে দেখেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement