সেই অভিজিত।
২০০৮
লোকটাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে প্রথম-প্রথম কেমন যেন লাগত! মোটেই গুরুগম্ভীর বাবা-টাইপ নয়। বরং, এ যেন ছটফটে হুল্লোড়বাজ এক ‘মজাদার কাকু’!
আমার সিক্সথ গ্রেডের পরে তখন আমরা সবে নতুন বাড়িতে থিতু হয়েছি। পিছনের উঠোন থেকে দু’টো মস্ত লাঠি নিয়ে বাবা আমায় একটা ছুড়ে দিল।
‘সোর্ড ফাইট?’— কথাটা বলল রণংদেহী ভঙ্গিতে।
আমি: ‘তোমায় হেরো ভূত বানিয়েই আমি খুশি হব।’
সন্ধে অবধি লাঠি ঠোকাঠুকি করে আমাদের যুদ্ধ চলল। যত বার হারছি, তত বার আবার খেলব বলছি। কিন্তু প্রতি বার আমিই হারলাম। বাবাকে এক দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমায় একবারটি জিততে দিলে না কেন?
বাবা হেসে বলেছিল, ‘‘তুই কি চাস না, তোকে আমি সমান-সমান মাপে দেখি!’’ ঘাড় সোজা করে লড়তে শিখিয়েছিল।
মশাল হাতে সে দিনের সেই মিছিল। ঢাকায়।
২০১২
বাবা কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করলেও বাড়িতে এক জন পুরোদস্তুর লেখক ছিল। বাবার বইগুলো কোনওটা সমকামিতার হয়ে সওয়াল করে, কোনওটা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের ভাইরাস নিয়ে। বাংলাদেশের মূলস্রোতের জীবনে ধর্মের বিধিনিষেধহীন মুক্তমনা আলোচনার পরিসর গড়ে তোলাই বাবার লক্ষ্য ছিল। ক্রমশ একজন সুপরিচিত অ্যাক্টিভিস্ট বা সমাজকর্মী হয়ে উঠছিল বাবা।
আমার ইলেভেন্থ গ্রেডে ন্যাশনাল এপি এগজামের ঠিক আগে ক্যালকুলাস টিচার চলে গিয়েছিলেন। অগত্যা বাবা ও আমার মধ্যে একটা চুক্তি হল। বাবা আমায় ক্যালকুলাস ও ফিজিক্স শেখাতে রাজি হলেন। বিনিময়ে আমায় বাবার লেখা ইংরেজি অনুবাদে সাহায্য করতে হবে।
‘‘বাবা এগুলো কী লিখেছ! গ্রামারের কোনও মাথামু্ণ্ডু নেই।’’
‘‘তৃষা, চুপচাপ ঠিক করে দে। লেখার বিষয়টা তো দেখ!’’
এ ভাবেই আমাদের দিন কাটত।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
ঢাকায় জাতীয় বইমেলায় যাওয়ার আগে মা-বাবা এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন বাল্টিমোরে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে এখনও আমি রয়েছি।
ওরা আমার জন্য বাক্সভর্তি লজেন্স, পোশাক, নোটবই, কলম এনেছিল। আমি ওদের কিছু দিইনি বলে আমার খারাপ লাগছিল। তাই তাড়াতাড়ি আমার ব্যাকপ্যাক থেকে দু’টো স্কার্ফ বের করলাম।
বাবা রাতভর সেই স্কার্ফ পরে থাকল।
মায়ের কী হাসি, ‘উ-ফ তোর দেওয়া কিছু একটা পেলেই হল, অভি সারা ক্ষণ সগর্বে ওটাই পরে থাকবে।’
২৬ ফেব্রুয়ারি (সকাল)
সাড়ে ১০টা নাগাদ কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের ক্লাসে ঢুকেছিলাম আমি। ৩০০ জনের ক্লাস। আমি পিছনের দিকে বসে। দুপুরের দিকে দেখি, ফোনে তিনটে মেসেজ জমে...বাংলাদেশ থেকে আমার তুতো ভাইবোনেদের পাঠানো। দেখেই আমার শরীর কাঁপতে থাকল! আমি নিঃশব্দে হাপুস কাঁদছি। আমার রুমমেটকে ফোন করলাম।
‘কী হয়েছে তোর, ঠিক আছিস!’— ও জিজ্ঞেস করল। ‘আমার বাবা আর নেই। মা আইসিইউ-তে ভর্তি বাংলাদেশে।’
২৬ ফেব্রুয়ারি (দুপুর)
কাঁদতে কাঁদতে কোনওমতে ফেসবুকে সে দিন এটা পোস্ট করেছিলাম আমি।
আমার বাবা একজন বাঙালি লেখক ছিলেন। বিজ্ঞানচর্চা ও নাস্তিকতা নিয়ে তাঁর বইগুলোর জন্য বিখ্যাত। বাবার নতুন বই প্রকাশের জন্য মা ও বাবা গত সপ্তাহে বাংলাদেশে বইমেলায় গিয়েছিলেন। ১৫ ঘণ্টা আগে ইসলামি মৌলবাদীরা বাবাকে কুপিয়ে মেরেছে। আমার মা সাঙ্ঘাতিক জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। বাবার মৃত্যু এখন বাংলাদেশে শিরোনাম। নিজের জন্য ততটা নয়, বাবার জন্যই আমি এটা লিখছি। এ দুনিয়াকে আরও ভাল করার লক্ষ্যে নিজের মত প্রকাশে বাবা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন।
বাংলাদেশে খুন হওয়ার জন্য এই পাপটুকুই যথেষ্ট।
আমার ছ’বছর বয়সে মা ও বাবার মেলামেশা শুরু হয়। পরের ১২ বছরে বাবা আমার বন্ধু, হিরো, সব থেকে গোপন কথা বলার বন্ধু, নাচের পার্টনার (যদিও দু’জনেই জঘন্য নাচতাম) এবং বাবা হয়ে উঠেছিলেন।
আমি খুব রেগে আছি বা ভেঙে পড়েছি, বললে কিছুই বলা হবে না। তবে এই দুনিয়া যতই গোল্লায় যাক, তা আরও ভাল করার জন্য লড়াই ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জীবনের শিক্ষা ও ভালবাসা জীবনভর আমার সঙ্গে থাকবে। আই লাভ ইউ সো মাচ, ড্যাড। সব কিছুর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ।
#শব্দেরমৃত্যুনেই
সে-দিন এই কথাগুলোই সবাই দেখেছিল।
কিন্তু তারা দেখেনি যে, আমায় রোজ রাতে ঘুমের ওযুধ খেতে হচ্ছে, যাতে আমার স্বপ্নে বাবার রক্তে ভেসে যাওয়া ছবিটা আর ফিরে না-আসে। মায়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবে দুশ্চিন্তা কিংবা দেখা হলেও মা আর কোনওদিন আগের মতো হবে না, বলে ভাবাটাও তো কেউ দেখেনি। খালি ভাবতাম, মায়ের দেখভালের জন্যও আমি যে অযোগ্য।
কেউ দেখেনি, আমি তখন শুধু বাংলাদেশি নিউজ নেটওয়ার্ক খুলে বসে থাকি, আমার বাবার মৃত্যুর সুবিচার চেয়ে রাজপথে হাজারো লোকের ফুটেজ দেখি, যাদের হাতের পোস্টারে আমার বাবার মুখের ছবি।
একটা মেয়ের রাতারাতি বোবা হয়ে যাওয়াও কেউ দেখেনি।
৩ মার্চ
মা আমেরিকায় ফেরার পরে আমি প্রথমে চিনতে পারিনি। মাথা ন্যাড়া। আমার মনে পড়ছিল, মা যখন থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কেমন ছোট্ট হয়ে গিয়েছিলেন, আর সারা ক্ষণ আমার বুকটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগত।
তখন রাত ১০টা। মায়ের জন্য আমি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিলাম। মাকে ঘিরে একজন ডাক্তার, এফবিআই এজেন্ট ও ক’জন নিরাপত্তারক্ষী। কেমন অবিশ্বাসের চোখে দেখছিলাম, মা তার হুইলচেয়ারটা যিনি ঠেলছিলেন, তাঁর সঙ্গে কী একটা ইয়ার্কি করল।
আমার দাদু মাকে দেখে কাঁদছিল। মায়ের ন্যাড়া মাথায়, ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে আদর করছিল।
মাকে মেয়ো ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তারেরা ব্যান্ডেজ খুলতেই আমি মায়ের সেলাইটা দেখলাম। মাথায় চার বার চাপাতির কোপ পড়লেও মায়ের মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়নি। চারপাশটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল হঠাৎ! কোনওমতে সামলে চেয়ারে বসে পড়ি। সে রাতটা ওই চেয়ারেই কেটেছিল।
আমি ঘুমোচ্ছি ভেবে, মা চুপিচুপি কাঁদতে শুরু করল। আমি আস্তে আস্তে মায়ের হাতে-পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, কষ্ট মুছিয়ে দিতে ঠিক যে-ভাবে মা আমায় শিখিয়েছিল, মাকে শিখিয়েছিল আমার নানি।
২২ মার্চ
আমি ক্যাম্পাসে একা ফিরে এলাম। আমায় বলা হয়েছিল, যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তারা এ বার আমার মা ও আমাকেও নিশানা করছে। মা বলেছিল, দিনের বেলা একা-একা কোত্থাও যাবি না, আর রাত্তিরে কোথাও যাবিই না! ব্যস!
এফবিআই-এর প্রতিনিধি এক মহিলা আমায় ভরসা দিয়েছিলেন, সম্ভবত আমায় নিয়ে ঘাতকদের তত মাথাব্যথা নেই। তবু আতঙ্কের থাবা গেঁড়ে বসা তাতে ঠেকানো যায়নি।
৩ মে
ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়দার শাখার এক নেতা একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। তাতে ইসলামের নামে অভিজিৎ রায়ের খুনের দায় স্বীকার করা হয়।
২৬ মে
লম্বা, মহাখাটুনির সেমেস্টার শেষে জর্জিয়ার বাড়িতে আমি তখন একা। সারা ক্ষণ মনে হতো, বাবা রয়েছে। এক্ষুণি দেখব, বাবা ওর স্টাডিতে কম্পিউটারে ঝুঁকে টাইপ করছে। কিংবা মা-বাবার শোওয়ার ঘরে কিছু একটা পড়ছে।
বাবার উপরে হামলার তিন মাস তখন কেটে গিয়েছে। কোনও কিছুই স্বাভাবিক হয়নি। আমি মেঝেয় শুয়ে কাঁদি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড দেখতে পেয়ে গিয়েছিল। ও আমায় ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
সেপ্টেম্বর
বাবা সারা ক্ষণ বিজ্ঞান ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে পড়াশোনা করত। মা রাজনীতি, ইতিহাস, নারীবাদ, সারা দুনিয়ার সংস্কৃতি-ভিত্তিক পড়াশোনা নিয়ে মেতে থাকত। একটি ক্রেডিট ব্যুরোয় সিনিয়র ডিরেক্টরের পদ থেকে চাকরিটা মা ছেড়ে দিল এ বার।
‘মা, তুমি কি এটাই করতে চাও?’— মায়ের কাছে জানতে চাই আমি।
‘‘কে জানে’’,— মা হাসল! ‘‘তোর বাবা তো নিজের ভালবাসার জন্য প্রাণ দিল, দেখি আমি যদি অন্তত নিজের ভালবাসাটুকুর জন্য বাঁচতে পারি।’’
সপ্তাহখানেকের মধ্যে মা ফের বেরিয়ে পড়ল। ইউরোপে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে দেখা করে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের অন্য সমাজকর্মীদের দেশটার বাইরে বার করে আনতে মা কাজ করছে, পাছে তাঁরাও আমার বাবার মতো খতম না-হয়ে যান। মা নিজে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়তো তখনও হতে পারেনি, কিন্তু খুব মরীয়া ভাবে চাইছিল বাকিদের নিরাপত্তাটুকু সুনিশ্চিত করতে।
আজ
যতই নৃশংস ভাবে বাবাকে খুন করা হোক, আমার মনে হয় না, বাবা অন্য ভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়ে বাবা বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার খুন ও কণ্ঠরোধের দিকে সারা দুনিয়ার নজর টেনে এনেছিল। যে দেশ না কি, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির শাসনে চলে বলে দাবি করে থাকে।
আমি জানি, আল-কায়েদা, আইএসআইএস, এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদের ভয়াবহ সব রূপ এখনও জলজ্যান্ত। কিন্তু নিজের কথাগুলো বলে এবং লিখে আমি একটা অভিঘাত তৈরি করছি। যে-সব মতাদর্শ আমাদের খতম করতে চাইছে, আমি, আমার মতো আরও অনেকে আস্তে আস্তে তা নিকেশ করতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy