Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
বর্ণবিদ্বেষে বেসামাল আমেরিকা

ডালাসের মিছিলে খুন পাঁচ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ

পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হলেও পায়ে পা মিলিয়েই হাঁটছিলেন কালো ও সাদা। এমনকী, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে হাসিমুখে নিজস্বী তুলছিলেন উর্দিধারীরা। আচমকাই ছন্দপতন। স্নাইপারের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন একের পর এক পুলিশ।

‘গুলি কোরো না’! কৃষ্ণাঙ্গ-হত্যার প্রতিবাদে ডালাসে এক বিক্ষোভকারী। ছবি: এএফপি।

‘গুলি কোরো না’! কৃষ্ণাঙ্গ-হত্যার প্রতিবাদে ডালাসে এক বিক্ষোভকারী। ছবি: এএফপি।

সংবাদ সংস্থা
ডালাস শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৭
Share: Save:

পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হলেও পায়ে পা মিলিয়েই হাঁটছিলেন কালো ও সাদা। এমনকী, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে হাসিমুখে নিজস্বী তুলছিলেন উর্দিধারীরা। আচমকাই ছন্দপতন। স্নাইপারের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন একের পর এক পুলিশ।

বৃহস্পতিবার রাতে ডালাসের এই হামলায় নিহত হয়েছেন পাঁচ পুলিশ। ন’জন আহতের মধ্যে সাত জনই পুলিশ। প্রত্যেকেই শ্বেতাঙ্গ। পুলিশের পাল্টা হানায় শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছে হামলাকারী, ২৫ বছর বয়সি মিকা এক্স জনসন। প্রাক্তন মার্কিন সেনা মিকা ডালাসেরই বাসিন্দা। পেন্টাগন সূত্রে খবর, সেনাবাহিনীতে থাকার সময়ে তার বিরুদ্ধে কখনও কোনও অভিযোগ ওঠেনি। তার সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের কোনও সংগঠন বা কোনও রাজনৈতিক দলেরও সম্পর্ক নেই।

গত কয়েক দিনে মিনেসোটা ও লুইজিয়ানায় পুলিশের গুলিতে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুকে ঘিরে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামে কৃষ্ণাঙ্গদের একটি সংগঠন দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ মিছিল করছিল। বৃহস্পতিবার রাত আটটা নাগাদ তেমনই একটি মিছিল বেরিয়েছিল ডালাসে। বেলো গার্ডেন থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে মিছিলটির পৌঁছনোর কথা ছিল ওল্ড রেড কোর্টহাউসে। আটশো জনের মিছিল। পাহারা দিচ্ছিলেন শ’খানেক পুলিশ।

মার্কেট আর মেইন স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছনো মাত্রই পুলিশদের লক্ষ করে ছুটে এল গুলি— পাশেই এক বহুতল কার পার্কিংয়ের তিন তলা থেকে। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন কয়েক জন। হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরেই পুলিশের ধারণা হয়ে যায় যে, মিছিল থেকে কোনও বিক্ষোভকারী এই হামলা চালাননি। মিছিলটিকে ঢাল বানিয়ে গুলি চালানো হয়েছে। তবে কত জন হানাদার আছে, সেটা স্পষ্ট হতে রাত কাবার হয়ে যায়। কার পার্কিং থেকে যে গুলি চালানো হচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেই জায়গাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। স্নাইপারকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। তবে পুলিশের হুমকিতে আদপেই দমেনি স্নাইপার। পাল্টা হুমকি দেয়, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বোমা রাখা হয়েছে। পুলিশ আরও এগোলে হামলার মাত্রা বাড়বে।

হুমকি শুনে শহরজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করলেও পিছিয়ে আসেনি পুলিশ। পৌনে এক ঘণ্টা ধরে হামলাকারীকে কাবু করার চেষ্টা চালিয়ে যায় তারা। কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে না পেরে শেষমেশ বোমা সমেত রোবট পাঠায় পুলিশ। সেই বোমা ফেটেই নিহত হয়
হামলাকারী। পুলিশ প্রথমে ভেবেছিল, আর এক জন হামলাকারীও রয়েছে। দু’জনে মিলে সংগঠিত ভাবে হামলা চালাচ্ছে। কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীও দাবি করেন, রাইফেল হাতে এক ব্যক্তিকে মিছিলের পাশেই দেখা গিয়েছে। সে রকম এক জনকে আটকও করে পুলিশ। তবে কিছু ক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। শুক্রবার সকালে সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশের এক শীর্ষকর্তা জানান, মিকা জনসনই একমাত্র হামলাকারী।

কেন এমন কাজ করল মিকা? পুলিশ জানিয়েছে, মরার আগে মিকা বলে, বেছে বেছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশদের মারতেই এই হামলা চালিয়েছে সে। কারণ, পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ-মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনা তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, মিকা বলেছিল, ‘‘সাদা চামড়ার মানুষদের, বিশেষ করে সাদা চামড়ার পুলিশদেরই মারতে চেয়েছি আমি!’’

তার এই ‘যুক্তি’ মানতে নারাজ দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এই মুহূর্তে তিনি পোলান্ডের ওয়ারস-তে, ন্যাটোর শীর্ষবৈঠকে। সেখান থেকেই ডালাসে হামলার কড়া নিন্দা করে বলেন, ‘‘এই হামলা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও জঘন্য। কালো মানুষের জীবনের মূল্য রয়েছে— এ কথাটার মানে এই নয় যে, সাদা মানুষের প্রাণের কোনও মূল্য নেই।’’

তবু বিতর্ক থাকছেই। কারণ, মার্কিন পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের বহু দিনের পুরনো অভিযোগের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে লুইজিয়ানা ও মিনেসোটার ঘটনা দু’টি। প্রথম ঘটনাটি মঙ্গলবারের। লুইজিয়ানায় সে দিন অ্যালটন স্টার্লিং নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে ‘বিনা প্ররোচনায়’ খুনের অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। আর তার রেশ মিটতে না মিটতেই বুধবার মিনেসোটায় ফিলান্ডো ক্যাস্টাইল নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে তাঁর গাড়ির মধ্যেই গুলি করে মারে পুলিশ। সে সময় গাড়িতেই ছিলেন নিহতের স্ত্রী। তিনি নিজেই স্বামীর মৃত্যুদৃশ্যের ভিডিও তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। যার জেরে কড়া সমালোচনার মুখে প়ড়ে মার্কিন পুলিশ। নিন্দার ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। দেশ জুড়ে পথে নামেন কয়েক হাজার প্রতিবাদী। যেমন কাল রাতে পথে নেমেছিলেন ডালাসবাসী।

হাজারো প্রতিবাদীর ভিড়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মিছিলে গিয়েছিলেন প্রৌঢ়া রেনে সিফলেট। দিশাহীন ভিড়ে তাঁর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে সব চেয়ে ছোটটি। তাঁর কথায়, ‘‘চেয়েছিলাম, মিছিলে হেঁটে ওদের একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা হোক। কিন্তু পরিস্থিতি যে এমন ভয়াবহ চেহারা নেবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।’’

নিহত অফিসারদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন প্রাক্তন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। আগামী কাল পেনসিলভ্যানিয়ার নির্বাচনী সভা বাতিল করেছেন তিনি। হোয়াইট হাউসের দৌড়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভাব্য রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য বিষয়টিকে ‘আইন-শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি’ বলে প্রশাসনকেই দুষেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দেশটাই তো আজ টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। অপরাধ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।’’

প্রশ্ন উঠছে মার্কিন মুলুকের ‘অনিয়ন্ত্রিত’ বন্দুক-আইন নিয়েও। যার ভয়াবহ প্রভাব স্পষ্ট সাধারণ এক মার্কিন নাগরিকের টুইটে— ‘‘পুলিশের গুলিতে কালো মানুষ, কৃষ্ণাঙ্গের গুলিতে শ্বেতাঙ্গ, স্কুল পড়ুয়ার গুলিতে তার সহপাঠী— কারও মৃত্যুই আর চাই না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE