মহাকরণ ভবন সংস্কারের কাজে আন্তর্জাতিক মানের পেশাদারি পরামর্শ নেওয়া যে প্রয়োজন, তা গোড়া থেকেই বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। দেরি করে হলেও সেই পথেই হাঁটছে রাজ্য সরকার।
গোড়ায় রাজ্য পূর্ত দফতর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কমিটির হাতে মহাকরণের দায়িত্ব দিয়েই নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই কমিটির রিপোর্টে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের মতামত চেয়েছেন। হেরিটেজ কমিশন বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে রিপোর্টটি নিয়ে। তারা পরামর্শ দিয়েছে, এ বিষয়ে বিশ্বের প্রথম সারির পেশাদারদের সঙ্গে কথা বলা হোক।
রাজ্য প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা এখন জানাচ্ছেন, হেরিটেজ কমিশনের আপত্তিগুলি খতিয়ে দেখে তা সংশোধন করা হবে। প্রশাসন ইতিমধ্যেই নামী ব্রিটিশ স্থপতি এবং পুরনো ভবন সংস্কারে পেশাদার ফিলিপ ডেভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইতিমধ্যে ফিলিপ এসে মহাকরণ ঘুরে দেখে গিয়েছেন। রাজ্য সরকার তাঁর পরামর্শ নেওয়ার প্রস্তাব ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছে পাঠিয়েও দিয়েছে। খুব শীঘ্রই হাইকমিশন ফিলিপের আসার দিনক্ষণ রাজ্যকে জানাবে। পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, “মায়ানমারে ইয়াঙ্গনের সচিবালয়টি হুবহু রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ধাঁচেই তৈরি। তার সংস্কারের কাজ করেছেন ফিলিপ। সে কারণেই ফিলিপের পরামর্শ নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান মধুমিতা রায়ের তত্ত্বাবধানে তৈরি রিপোর্টটি নিয়ে হেরিটেজ কমিশনের আপত্তি কোথায়? মহাকরণ সংস্কারের দু’টি স্তর রয়েছে। একটি রাইটার্স বিল্ডিংকে তার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়া এবং অন্যটি বর্তমান সময়ের কথা ভেবে মহাকরণের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা। কিন্তু হেরিটেজ কমিশনের কর্তারা বলছেন, “এই দু’টি বিষয়ের উপরে জোর না দিয়ে যাদবপুরের ৫০ পাতার রিপোর্টের মধ্যে ২৮ পাতা জুড়ে রয়েছে শুধু মহাকরণের ইতিহাস।” অথচ পুরনো ভবন সংস্কারের জন্য যে সব পূর্ব-সমীক্ষা করতে হয়, তা করা হয়নি বলে কমিশনের দাবি। এ ব্যাপারে অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি মধুমিতা দেবী। তিনি বলেন, “এটুকুই বলতে পারি, হেরিটেজ কমিশন যে সব প্রশ্ন তুলেছিল, তার জবাব দেওয়া হয়েছে।” এই রিপোর্ট তৈরির সঙ্গে যুক্ত যাদবপুরের অন্য অধ্যাপকেরা বলছেন, “হেরিটেজ কমিশনের বুঝতে কোথাও ভুল হয়েছে। এটা তো বিস্তারিত রিপোর্ট ছিল না।”
হেরিটেজ কমিশন ঠিক কী বলছে? কমিশনের এক কর্তার বক্তব্য, পুরনো ভবন সংস্কারের কাজ শুরু করার আগে তার ত্রুটি-চিহ্নিতকরণ (ডিফেক্ট ম্যাপিং) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে কাজে স্থপতিরা এ বিষয়ে বার্নার্ড এম ফিল্ডেনকে গুরু বলে মানেন। ফিল্ডেনের বইতে এ ধরনের ভবনের পরিস্থিতি-সমীক্ষা (কন্ডিশন সার্ভে) কী ভাবে করা উচিত, তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া রয়েছে। কিন্তু কমিশনের কর্তাদের দাবি, “যাদবপুরের রিপোর্টে এ ধরনের কোনও সমীক্ষা করা নেই।” মহাকরণ তৈরির সময়ে বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল না। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা, লিফ্ট, এসি, কম্পিউটার আর তারের জালও ছিল না। ফলে যত দিন গিয়েছে মহাকরণের অগ্নিরোধক ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। কমিশনের বক্তব্য, এ ব্যাপারে কী করা হবে, তার নির্দিষ্ট প্রস্তাবও যাদবপুরের রিপোর্টে নেই।
হেরিটেজ কমিশনের তোলা এই সব প্রশ্ন যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত বলেই মনে করেন আইআইটি খড়গপুরের অধ্যাপিকা এবং কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটের সংস্কারের দায়িত্বে থাকা সঙ্ঘমিত্রা বসু। তিনি বলছেন, “প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।” প্রাচীন সৌধ সংস্কারে বিশেষজ্ঞ সুনীতা কোহলিরও বক্তব্য হল, মহাকরণ সংস্কারের আগে বিশদ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ঠিক এই কথাই বলছে হেরিটেজ কমিশনও। কমিশনের অন্যতম সদস্য পার্থ দাসের বক্তব্য, “পুরনো ভবন সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত কোনও পেশাদারকে দিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করানো উচিত বা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত।” রাজ্য প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। সেই কারণেই ব্রিটিশ স্থপতি ফিলিপ ডেভিসের পরামর্শ নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।
১৭৭৬ সালে মূলত রাইটারদের থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল বলেই লালদিঘি পাড়ের ভবনটির নাম রাইটার্স বিল্ডিং। স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদর দফতর হয়ে ওঠে এই ভবন। তার পরে মহাকরণের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয়েছে নতুন আরও চারটি ভবন। যাদবপুরের তৈরি নকশায় ওই চারটি ভবন ভেঙে ফেলার কথা বলা হয়েছে। তার বদলে পিছনের ব্লকগুলিকে আরও চওড়া করে মহাকরণকে একটি সার্বিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মধ্যের ফাঁকা অংশে একতলা ভবনটি জুড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে মেন ব্লক এবং পিছনের ব্লকের সঙ্গে। ওই ভবনগুলিতে ভিআইপি-লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি রাখার প্রস্তাব রয়েছে। উপরের ছাদে তৈরি হবে বাগান। একটি অংশে একটি জাদুঘর তৈরির পরামর্শও রয়েছে।
এই ভাবনাকে সমর্থন জানিয়েছিল রাজ্য প্রশাসনের মহাকরণ সংস্কার সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি। হেরিটেজ কমিশন আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে, এই নকশা মহাকরণকে বদ্ধ করে তুলবে। বাগান তৈরির ভাবনার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা। কমিশনের বক্তব্য, মহাকরণে জাদুঘর তৈরি হলে সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে।
পূর্ত দফতর জানাচ্ছে, ১৫ মার্চের মধ্যে মহাকরণে থাকবে না, এমন সব দফতরই উঠে যাচ্ছে। এর পরেই জোরকদমে মহাকরণ সংস্কারের কাজ শুরু করা যাবে। তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, সংস্কারের যাবতীয় তথ্য খুব শীঘ্রই ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। যা দেখে সাধারণ মানুষ তাঁদের ভাবনা এবং মতামত জানাতে পারবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy