দিদি বলছেন চ্যালেঞ্জের সুরে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকারের উদ্দেশে উঠতে-বসতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, সাহস থাকলে তাঁকে গ্রেফতার করে দেখান! কত বড় জেল আছে, তৈরি রাখুন! সত্যিই দিদি গ্রেফতার হলে দলের কী পরিকল্পনা হবে, এ বার প্রকাশ্যে তা-ই ঘোষণা করে বসলেন তৃণমূলের এক বিতর্কিত সাংসদ! দিদির নাম জড়িয়ে হুমকি দিয়ে দিদির চ্যালেঞ্জকেই রাতারাতি বদলে দিলেন বিড়ম্বনায়!
বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ ইদ্রিশ আলি গিয়েছিলেন সন্দেশখালিতে ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ফাইনালের মতো নির্বিষ এক অনুষ্ঠানে। সেখানেও সারদা এবং সিবিআই নিয়ে আশঙ্কা গোপন করে রাখতে পারেননি তিনি। বলে বসেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। জেনে রাখুন, মমতাকে ছুঁতেও পারবেন না। তাঁর গায়ে হাত দিতে পারবেন না। আর যদি ছোঁয়া হয় কিংবা গ্রেফতার করা হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে আগুন জ্বলবে! সেই আগুনে কিন্তু অনেককেই পুড়ে মরতে হবে!” রাজ্যের দুই মন্ত্রী গিয়াসুদ্দিন মোল্লা এবং হায়দার আজিজ সফির উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে ইদ্রিশ আরও বলেছেন, “মনে রাখতে হবে মমতা ভারতের অগ্নিকন্যা! মোদীও তাঁকে সামলাতে পারবেন না!”
ইদ্রিশ এমন জ্বালাময়ী মন্তব্য করেছেন সোমবার। বর্ষশেষের দিনে টিভি চ্যানেল-বাহিত হয়ে তাঁর ওই মন্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তাপস পাল-কাণ্ডের জেরে তৃণমূলের কুকথার ইতিহাস এখন গোটা দেশেই চর্চিত। ইদ্রিসের হুঙ্কারের কথা জেনে বুধবার জাতীয় স্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর, মুখতার আব্বাস নকভি থেকে বিরোধী শিবিরের মণীশ তিওয়ারি, সীতারাম ইয়েচুরি, সকলেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আর রাজ্য স্তরের বিরোধীরা আরও সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন গোটা তৃণমূল দলটারই কি এখন ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হল? মনের আশঙ্কাই কি বারবার মুখের কথা হয়ে বেরিয়ে আসছে? প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তৃণমূলের অন্দরেও!
বস্তুত, সারদা-কাণ্ডের ধাক্কায় হাওয়া এখন খুবই এলোমেলো। কার পরে কে সিবিআইয়ের ডাক পাবেন, কে ডাক পেলে কী ধরনের পাল্টা পদক্ষেপ হবে, এ সব নিয়ে নিরন্তর আলোচনা চলছে শাসক দলের অন্দরে। বর্ষীয়ান নেতা-মন্ত্রীরা পর্যন্ত কোনও না কোনও বিষয় ধরে ভিন্ন সুর গেয়ে জল মাপতে চাইছেন। একের পর এক নেতার শ্রীঘরে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০১৬ পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদ ব্যাট করবে কি না, সেই জল্পনাও উঠতে শুরু করে দিয়েছে তৃণমূলের ভিতরে। এই রকম অস্থির সময়েই দলের ভিতরের উদ্বেগের স্রোত বাইরে এনে ফেলেছেন ইদ্রিশ এমনই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। এমনিতেই ইদ্রিশের মুখের আগল নেই, চাপের সময়ে আরও বেসামাল হয়ে গিয়েছেন!
বিরোধীরা এর সঙ্গেই আরও যোগ করছেন, সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসতেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘চোর’দের নাম বলতে গিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা। তাঁর সেই তালিকার কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্রেরা ইতিমধ্যেই ধৃত। বাদ রয়েছেন মুকুল রায় এবং মমতা নিজে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার প্রশ্ন, “ওঁর দলনেত্রীর মতো ইদ্রিশের ভবিষ্যদ্বাণীও যদি ফলে যায়? তখন তো মুখ লুকনোর জায়গা পাবেন না!”
ইদ্রিশের মন্তব্য শুনে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সরাসরিই বলেছেন, “বোঝাই যাচ্ছে, কেমন ভয় তৃণমূল পেয়েছে! ওদের রাজনীতি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। সে সবের নমুনা রোজ বেরোচ্ছে।” সিপিএমেররাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “নিজেদের অপরাধবোধের আগুনে নিজেরাই এখন জ্বলছেন! মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেলে তদন্তকারী সংস্থা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, প্রয়োজনে গ্রেফতারও করবে। তৃণমূলের নেতা-সাংসদেরা আগেই ভয় পেয়ে ভয় দেখাচ্ছেন!” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান অবশ্য মনে করছেন, “স্তাবকতা করে নাম কেনার জন্য ইদ্রিশের মতো লোকজন এমন বলছেন! তৃণমূলে এখন এ সবের প্রতিযোগিতা চলছে!”
নিয়ম বলছে, মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে গেলে তার আইনি প্রক্রিয়া চালাতে হয় সতর্কতার সঙ্গে, বিধি মেনে। আইনতই কিছু রক্ষাকবচ মুখ্যমন্ত্রীর আছে। অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণসাপেক্ষে তাঁকে গ্রেফতার করতে গেলে রাজ্যপালের আগাম সম্মতি নিতে হবে। এত কিছুর তোয়াক্কা না করে আইনজীবী ইদ্রিশ যে ভাবে আগ বাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারির প্রসঙ্গ তুলে হুমকি দিতে গিয়েছেন, তাতে বিব্রত এবং ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব। সারদা-কাণ্ডে এমনিতেই বিব্রত দলে ইদ্রিশের ডেকে আনা বিড়ম্বনা নিয়ে এ দিন নেতা-মন্ত্রীদের অনেকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা সহকর্মীদের কাছে প্রশ্ন তোলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে ইদ্রিশকে কে কথা বলতে বলেছে? কোথাও তো মুখ্যমন্ত্রীকে ধরা হবে, এমন কিছু শোনা যায়নি! তা হলে কেন উনি এই বিষয়ে প্রকাশ্যে বলতে গেলেন?” দল কি ইদ্রিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে?
প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুধু বলেছেন, “ইদ্রিশকে ডেকে জিজ্ঞাসা করব।”
বিপাকে পড়ে ইদ্রিশ অবশ্য দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে! তাঁর যুক্তি, অনেক সময় বলা কথার আগে বা পরের শব্দ বাদ দিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়। ইদ্রিশের এ দিনের ব্যাখ্যা, “মনে রাখতে হবে, আমি কিন্তু বলেছিলাম যদি কেউ মমতাকে কলুষিত কিংবা গ্রেফতারের চেষ্টা করেন, তা হলে আমি এবং আমার মতো এ রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।” তিনি কি এই ধরনের কথা বলে দলেরই অস্বস্তি বাড়াচ্ছেন না? তখনও ইদ্রিশের উত্তর, “মনে রাখবেন, আমি কিন্তু ‘যদি’ কথাটা ব্যবহার করেছিলাম!” যদিও সেই ‘যদি’ সমেতই তাঁর মন্তব্য প্রচারিত হয়েছে এবং তাতে অর্থের কোনও অন্যথা হয়নি!
বিতর্ক অবশ্য ইদ্রিশের কাছে নতুন নয়। ক’দিন আগেই বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডলের হাত কেটে নেওয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে তৃণমূল সাংসদ পাল্টা হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁরাও হাত কেটে নিতে পারেন! বিতর্ক এবং মামলার ইতিহাস আরও আছে। বিজেপি নেতা তথাগত রায় সেই প্রসঙ্গ টেনে এনেই এ দিন বলেছেন, “বাম আমলে ২০০৮ সালে একটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দিন ইদ্রিশ মারাত্মক উত্তেজনা তৈরি করেছিলেন।” তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে অবশ্য সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ইদ্রিস। এখন ফের তিনি আগলহীন! যে কারণে সন্দেশখালির ওই অনুষ্ঠানেই সিপিএমের স্থানীয় বিধায়কের নাম করে ইদ্রিশ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “সিপিএমের অত্যাচারের সেই সব পুরনো দিনের কথা মনে রাখতে হবে। তাই বলি, এখানকার সিপিএমের বিধায়ক নিরাপদ সর্দাররা এখন নিরাপদে বসে আছেন। আমরা মনে করলে কিন্তু আপনারা আর নিরাপদে থাকতে পারবেন না! কিন্তু আমরা সে সব চাই না।”
যে সবের প্রেক্ষিতে সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “পশ্চিমবঙ্গ কি দেশের বাইরে? দেশের সংবিধান, আইন-কানুন কিছুই এখানে খাটে না? তাপস পাল থেকে ইদ্রিশ, শাসক দলের জনপ্রতিনিধিরা যেমন খুশি হুমকি দিতে পারেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy