Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মন কাড়তে না-টক কথা

অভিনয়ের দক্ষতা রাজনীতিতে কতটা জরুরি? অন্য যে যা বলে বলুক। অর্পিতা বলবেন, ‘খুব জরুরি।’ অর্পিতা মানে নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থাকা বিদ্বজ্জনদের তালিকায় প্রথম সারির মুখ। আজ নয়, সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে। রাজ্যসভায় তৃণমূলের আসন খালি হলে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ইদানীং কখনও সখনও লোকমুখে ভেসে উঠত তাঁর নাম। কিন্তু সম্ভাবনার সেই বুদ্বুদ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেও দেরি হতো না।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

অভিনয়ের দক্ষতা রাজনীতিতে কতটা জরুরি?

অন্য যে যা বলে বলুক। অর্পিতা বলবেন, ‘খুব জরুরি।’ অর্পিতা মানে নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থাকা বিদ্বজ্জনদের তালিকায় প্রথম সারির মুখ। আজ নয়, সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় থেকে। রাজ্যসভায় তৃণমূলের আসন খালি হলে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ইদানীং কখনও সখনও লোকমুখে ভেসে উঠত তাঁর নাম। কিন্তু সম্ভাবনার সেই বুদ্বুদ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেও দেরি হতো না।

কানে কানে মমতা অবশ্য অর্পিতাকে অনেক দিন আগেই বলে রেখেছিলেন, লোকসভায় তাঁকে লড়তে পাঠাবেন। বলেছিলেন, “অর্পিতা, রেডি থেকো। এখন চুপ করে থাকবে। ঠিক সময়মতো জেনে যাবে।” প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হল যে দিন, অর্পিতা সে দিন নাটক সংক্রান্ত কাজে দিল্লিতে। সঙ্গে ব্রাত্য বসু, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়রা। রাজধানীতে বসেই টিভি থেকে জানতে পারেন, তৃণমূল নেত্রী বালুরঘাটের জন্য তাঁকে বেছেছেন।

বাম-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের বড়দাগিরি আঙুলে গোনা যে ক’টি জায়গায় শরিকদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত, বালুরঘাট নিঃসন্দেহে তাদের একটি। সেখানে, বিশেষত বালুরঘাট শহরে, সিপিএমের সঙ্গে পাল্লা নেওয়ার ক্ষমতা রাখত আরএসপি। তাদের হাতে সিপিএম যে কতবার মার খেয়ে মান খুইয়েছে, হিসেব নেই।

হায় রে, কবে কেটে গেছে বিশ্বনাথের কাল! বালুরঘাটের সেই প্রতাপশালী আরএসপি মন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরী নিজেই গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে বহু ভোটে হেরে যান। সরকার হাতছাড়া হওয়ায় তাঁর দলও কোণঠাসা। খাস বালুরঘাটে এখন তৃণমূলের মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তীর পৌষমাস চলছে। এই অবস্থায় গত বারের সাংসদ প্রশান্ত মজুমদারকে আরএসপি এ বার প্রার্থী করেনি। পোশাকি যুক্তি, স্বাস্থ্যগত। তবে গুঞ্জনে প্রকাশ, তাঁর সঙ্গে নাকি প্রতিপক্ষের লোকজনদের ‘ঘনিষ্ঠতা’ দলের চোখে ভালো ঠেকেনি। বিশ্বনাথ চৌধুরীর প্রার্থী হওয়ার বাসনা ছিল কিনা, কাগজে কলমে তারও কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। সবটাই লোকের কথা। তবে বর্তমান প্রার্থী বিমলেন্দু সরকার দলে প্রবীণ হলেও শহর-কেন্দ্রিক বলেই বেশি পরিচিত। সর্বোপরি, লোকসভা কেন্দ্রটির নিরিখে একমাত্র কুশমন্ডি বিধানসভা কেন্দ্র ছাড়া সর্বত্রই জোড়া ফুলের ‘সুবাস’।

এমন একটি সাজানো বাগান পেয়ে অর্পিতা যে তাঁর নেত্রীর প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। এবং আছেনও। তা বলে সজ্জিত বাগিচার গোলাপে কাঁটা নেই, এমনটাই বা তিনি বলেন কোন মুখে! কৃতজ্ঞতার কার্পেটে সেই কাঁটা চাপা দেওয়া গেলেও একেবারে উপড়ানো যায় কি?

বালুরঘাটে পা দিয়েই পরিস্থিতি টের পেয়েছিলেন অর্পিতা। তাঁর কর্মিসভা ঘিরে অন্তর্দলীয় মারামারি, তাঁর প্রার্থী হওয়ার প্রশ্নে দলের ভিতরে নানা অসন্তোষ, তাঁর কপালে বহিরাগতের তকমা সেঁটে দেওয়া, এমনকী জেলার নেতৃস্থানীয়দের কারও মধ্যে জমে থাকা অভিমান সব দু-হাতে সরাতে সরাতে এগোতে হয়েছে তাঁকে। আর তারপরেই তাঁর ওই অমোঘ উপলব্ধি। যার সার কথা: নাটক করতে জানলে ‘না-টক’ কথা দিয়ে মন জয় করা সম্ভব।

“আমি বুঝি, কী ভাবে কোন কথাটা কত আন্তরিক ভাবে বলা যায় এবং সেই কথা দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করা যায়”, বলেছেন তিনি। নাটকের তুলনা টেনেই বুঝিয়েছেন, মঞ্চে কোনও চরিত্র অভিনয় করার সময় দর্শকের কাছে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরাটাই তো যে কোনও নাট্য পরিচালক বা অভিনেতার শিক্ষা। “আমি দুটো কাজই করি। তাই আমার কোনও অসুবিধা হয় নি। বরং ওই অভিজ্ঞতা আছে বলেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার কথা হারিয়ে যায় না। যা বলতে চাই, তা স্পষ্ট বলতে পারি। বোঝাতেও পারি।”

দক্ষিণ দিনাজপুরের ডাকসাইটে তৃণমূল নেতা, হরিরামপুরের বিধায়ক বিপ্লব মিত্র কি অর্পিতার ওই টিউটোরিয়ালে সত্যিই অনুপ্রাণিত? কারণ তিনি নিজেই মেনে নিয়েছেন, তাঁকে লোকসভায় প্রার্থী না করার জন্য দলের কর্মীদের মধ্যে গোড়ায় একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেসব মিটে গিয়েছে। এখন তাঁরা অর্পিতাকে জেতাতে কোমর বেঁধেছেন। অপির্তাও শতমুখে জানাচ্ছেন, “বালুরঘাট কেন্দ্রটি বেশ বড়। একদিকে বিপ্লবদা, অন্যদিকে শঙ্করদা। দুজনে দুদিক সামলাচ্ছেন। আমি শুধু তাঁদের হুকুম মতো চলছি।”

স্ক্রিপ্টটা মনে মনে এভাবেই ছকে নিয়েছেন তিনি। জেলায় এসেই নেতা, কর্মীদের বিশ্বাস করিয়েছেন যে, ভোটে জিতে এম পি হতে পারলে তিনি দিল্লি গিয়ে কাজ আদায় করে আনার যোগসূত্র হিসেবে থাকবেন। এখানকার দৈনন্দিন রাজনীতিতে কোনওভাবেই মাথা গলাবেন না। বলেছেন, “আমি হাতেকলমে রাজনীতির কিছুই বুঝি না। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা আছে, বিশ্বাস আছে, বোধবুদ্ধি আছে। আপনারা আমাকে শিখিয়ে দিন। যেমনটি বলবেন, করব।” তারপরে? প্রার্থীর প্রত্যয়ী মন্তব্য: “এখন আর আমার কোনও অসুবিধাই নেই।” বালুরঘাট শহরের কংগ্রেস পাড়ায় তৃণমূলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যালয় তাই রাত সাড়ে দশটাতেও গমগম করে। গরম চা, কুচো নিমকির অকৃপণ আতিথ্য জানিয়ে দেয়, অল ইজ ওয়েল!

অল্প আগেই শহরের উপকণ্ঠে চেঙ্গিসপুর অঞ্চলে অনেকগুলি সভা করতে করতে আসতে হয়েছে তাঁকে। হাল্কা বৃষ্টিতে ধুলো সেখানে কাদা। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে আধো আঁধারে বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গে গানও : ‘ তোলো আওয়াজ, মানুষ হাসছে । তোলো আওয়াজ.....’। গান না গাইলে তাঁর কোনও সভাতেই নাকি ছাড় নেই।

বালুরঘাট এমনিতেই বেশ সংস্কৃতিবান শহর বলে খ্যাত। বিশেষত নাট্যচর্চায় এই শহরের নামডাক আছে। সেই সূত্রে অর্পিতা ঘোষ কি এখানে কোনও বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন? শহরের নাট্যামোদীরা অবশ্য এসব নিয়ে ঝেড়ে কাশতে নারাজ। হয়তো নাট্যমঞ্চের অর্পিতা এবং ভোট-মঞ্চের অর্পিতাকে খাপে খাপ মেলানো যায় কি না, সেই হিসেব এখনও কষা হয়ে ওঠেনি তাঁদের।

অন্য বিষয়গুলি:

balurghat debashis Bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE