Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ভূমির লড়াই, আবহে সৌজন্য

হাট বসেছে রবিবারে। নবাবগঞ্জে, নদীর পাড়ে। দেদার বিকোচ্ছে মাংস, মুরগি, তরিতরকারি থেকে শাড়ি-জামা-কাপড়-গামছা সবকিছু। বেলা বাড়তেই তিনটে হাঁসের দাম ৮০০ থেকে নেমে গিয়েছে ৫০০ টাকায়। সজনে ডাঁটার বান্ডিল সস্তায় দিতে ঝোলাঝুলি করছেন দোকানি। কে কার জায়গা দখল করেছেন, তা নিয়ে বচসা দুই বিক্রেতার। এই সব নিয়েই মত্ত সবাই, অন্য কোনও পার্থিব প্রসঙ্গে তাঁদের আগ্রহ নেই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০২
Share: Save:

হাট বসেছে রবিবারে। নবাবগঞ্জে, নদীর পাড়ে।

দেদার বিকোচ্ছে মাংস, মুরগি, তরিতরকারি থেকে শাড়ি-জামা-কাপড়-গামছা সবকিছু। বেলা বাড়তেই তিনটে হাঁসের দাম ৮০০ থেকে নেমে গিয়েছে ৫০০ টাকায়। সজনে ডাঁটার বান্ডিল সস্তায় দিতে ঝোলাঝুলি করছেন দোকানি। কে কার জায়গা দখল করেছেন, তা নিয়ে বচসা দুই বিক্রেতার। এই সব নিয়েই মত্ত সবাই, অন্য কোনও পার্থিব প্রসঙ্গে তাঁদের আগ্রহ নেই।

এখানে মহানন্দার জল মোটামুটি মনোরম। ডুব দিয়ে, সাঁতার কেটে স্নানের আরাম পাওয়া যায়। দুপুরের খর রোদে সেই জলে ছেলের দলের ঝাঁপাইঝুপাই চলছে। গাঁয়ের বধূরা নদীর ঘাটে ভিড় করেছেন। গঞ্জের ধূলিধূসর, এবড়োখেবড়ো রাস্তার ধারে চায়ের দোকানগুলিতে ছোটখাটো গুলতানি। গাছের ডালে, বাড়ির চালে কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি-র ব্যানার-ঝান্ডার বর্ণময় সহাবস্থান।

এই কূল ধরেই তো তাঁর যাওয়ার কথা! পথ বলছে, তিনি গিয়েছেন। মেঠো ধুলোর উপর ভারী চাকার ছাপ স্পষ্ট। সেই চিহ্ন দেখে দেখে এগোনো। কিন্তু কোথায়? কতদূর?

এখানে তৃণমূলের কোনও মিটিং হচ্ছে? নেতাদের গাড়ি যেতে দেখেছেন আপনারা? প্রশ্ন শুনে কেউ অবাক চোখে তাকান। কেউ আন্দাজে হাত তুলে বলেন, আরও পাঁচ কিলোমিটার যেতে হবে। এগোতে এগোতে রাস্তা আরও খন্দময়। একটু বৃষ্টিতেই ধুলো কোথাও কোথাও কাদা। অগ্রগতি পিছু টেনে ধরে।

অগত্যা ফিরে আসা। মনে গুনগুনিয়ে ওঠে ভূমি-র গীতি: ‘তোমার দেখা নাই রে.....।’ সৌমিত্র রায় এখানে ভূমি-পুত্রই বটে। তৃণমূলের ব্যানারে, হোর্ডিংয়ে এটাই তো তাঁর ব্র্যান্ডিং। কোনওক্রমে মোবাইলে ধরা গেল তাঁকে। জানালেন, আদিনা স্টেশনের কাছে হিমঘরের সামনে দেখা মিলবে। গোঁসাইপাড়া পর্যন্ত গিয়ে বোঝা গেল, প্রার্থী গ্রামের ভিতরে ঘুরছেন। মোরামের রাস্তা দিয়ে রাঙা ধুলোর মেঘ উড়িয়ে, সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে খোলা জিপে দাঁড়িয়ে তিনি এলেন। জায়গাটি খুব জনবহুল নয়। তাই তাঁর রোড শো-তে খুব সাড়া পড়ল, বলাটা সত্যের অপলাপ হবে। তবু তিনি ঘুরলেন। কোথাও বাড়ির মেয়েরা এসে হাত মেলালেন, প্রতি-নমস্কারও জুটল। তিনি এগিয়ে চললেন আরও দূরে।

ঠিক তখনই হবিবপুরে গ্রাম-সফর করছিলেন মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের মৌসম বেনজির নূর। দিনভর রোদ মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পড়ন্ত বিকেলে হালদারপাড়ায় একটি বাড়িতে দুপুরের খাওয়া। সেই ফাঁকে ধরা গেল তাঁকে। বয়সে সৌমিত্রবাবুর চেয়ে অনেকটা ছোট হলেও রাজনীতিতে মৌসম সিনিয়র। তিনি গত বার জেতা সাংসদ। ভোট করার আটঘাটও তাই কিছুটা জানা হয়ে গিয়েছে।

বরকত গনি খানের ভাগ্নি পরিচয়টা কখনও মৌসমের মুকুটের পালক, কখনও তুরুপের তাস। কোতোয়ালির বাড়ি থেকে এই পরিচয় বহন করেই সুজাপুরে প্রথম বিধানসভা উপনির্বাচনে নেমেছিলেন তিনি। তার পরে লোকসভায়। সেই ট্র্যাডিশন এ বারেও অব্যাহত। প্রচার আছে, মৌসমকে গত পাঁচ বছর এলাকায় বড় একটা পাওয়া যায়নি। প্রচারে নেমে সেই দাগ মুছতে তিনি এখন নির্বাচনী কেন্দ্রের গায়ে প্রায় লেপ্টে রয়েছেন।

সৌমিত্রের সঙ্গে মৌসমের পরিচয় পারিবারিক সূত্রে। মৌসমের বরকত মামাকে সৌমিত্র ছোটবেলা থেকে বরকত জেঠু বলে ডেকে এসেছেন। তাঁর আর এক মামা, মালদহ দক্ষিণের কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরীকে বলেন ডালুকাকা। মৌসমের মা সৌমিত্রের রুবি পিসি। এই অবস্থায় নির্বাচনী লড়াইয়ের ঝাঁঝ কোথাও যেন সম্পর্কের উষ্ণতার কাছে হেরে যায়।

চারপাশে ভোটের হাওয়া যখন নানা অসৌজন্য, অসূয়া, অসম্মানের বিষে ভরপুর, তখন বেশ লাগে সৌমিত্র এবং মৌসমের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। হরিশ্চন্দ্রপুরে দেখা হয়েছিল দুই প্রতিপক্ষের। সৌজন্য প্রকাশে দ্বিধা করেননি কেউ। প্রার্থী সৌমিত্র সম্পর্কে কোনও কটূ মন্তব্য করতেও চান না মৌসম। তিনি বলেছেন, “ছোটবেলা থেকে আমি ওঁকে জানি। বাড়ির পরিচয়। উনি ভাল লোক। ওঁর সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা আমার মুখে আসবেই না।” একই সুর সৌমিত্রের, “মৌসমকে কত ছোট দেখেছি! বরকত জেঠু, ডালুকাকার কোলে উঠে আমি বড় হয়েছি। আজ ভোটে দাঁড়িয়ে তা ভুলে যাব? হয় নাকি!”

রাজনীতির কারবারিদের সঙ্গে তাঁর যে বহুক্ষেত্রে গুণগত ফারাক রয়েছে, সেটা বুঝিয়ে দিতেও সৌমিত্র রায় অকপট। তাঁর কথা, “আমি এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না, যা অলীক। তাতে ভোট এলে আসবে, না এলে কিছু করার নেই। আমার দলের ছেলেদেরও বলে দিয়েছি, প্রচারে বেরিয়ে অহেতুক এটা করব-ওটা করব বলবে না। কী করা যাবে-না যাবে, সে সব না বুঝেই দুমদাম চারটে বলে দিলে আমি এ সবের মধ্যে নেই।” প্রচারে নেমে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সৌজন্য প্রকাশের পাশাপাশি এই স্বচ্ছতাও হয়তো ভোটের ময়দানে নবাগত সৌমিত্রকে আলাদা ভাবে চিনিয়ে দিতে পারবে।

কলকাতার সুপরিচিত বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’র অন্যতম স্রষ্টা সৌমিত্র মালদহের ভূমিপুত্র হলেও জেলার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ এখন কম। হরিশ্চন্দ্রপুরে তাঁদের বিশাল জমিদারবাড়ি। মালদহ শহরে তাঁর প্রয়াত জ্যাঠামশাই, চোখের চিকিৎসক পিনাকীরঞ্জন রায়ের বাড়িটি প্রাসাদোপম। পিনাকীরঞ্জন শুধু বিশিষ্ট চিকিৎসকই ছিলেন না, দানধ্যান ও সমাজসেবার জন্য মালদহের একটি বড় অংশের মানুষ তাঁকে মনে রেখেছেন। সৌমিত্র নিজেই বলেন, “আমার ভূমি ব্যান্ড এখানে ক’জন চিনবে! আমাকে আগে চিনবে পিনাকী রায়ের ভাইপো বলে। মালদহের মানুষের কাছে সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। যেখানে যাচ্ছি, শুনছি, পিনাকী রায়ের ভাইজতা এসেছে।” আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে, তাঁর দলের প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি হচ্ছে না? সৌমিত্র শশব্যস্তে জবাব দেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়, নিশ্চয়। সেটা তো অবশ্যই আছে।”

ধাঁধা লাগে। মালদহ উত্তরে লড়াইটা কি আসলে গনি খানের ভাগ্নির সঙ্গে পিনাকী রায়ের ভাইপোর? কংগ্রেস, তৃণমূল ইত্যাদি শুধুই ভোট-মেশিনে তাঁদের চেনার প্রতীক!

দিনের প্রচার সেরে সে দিন সন্ধ্যায় মালদহ শহরে তাঁর ডাক্তার-জেঠুর বাড়ির বিশাল বসার ঘরে চকচকে মোজাইক-মেঝেতে গা এলিয়ে একটু রিল্যাক্স করছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। ঘরে নরম আলো ছড়ানো। টিভি-তে ‘টি-২০’। “হচ্ছে না, হচ্ছে না! ব্যাটে বলে হচ্ছে না” যুবরাজের খেলা দেখতে দেখতে বলে উঠলেন সৌমিত্র রায়। কেমন যেন স্বগতোক্তির মতো!

অন্য বিষয়গুলি:

debashis bhattacharya maldah
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE