Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
দায় এড়িয়ে ঢালাও প্রতিশ্রুতি

বকেয়া ডিএ-র দেখা নেই, দশ লক্ষ চাকরির ঘোষণা

মাইনে বাড়াতে না-পারার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপিয়ে আড়াল খোঁজার চেষ্টা। পাশাপাশি, নতুন দশ লক্ষ ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থানের ঘোষণা। বুধবার পানাগড়ে মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ হেন বক্তৃতা শুনে বিরোধী তো বটেই সরকারের অন্দরেই বিভ্রান্তি চরমে। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘভাতার ব্যবধান নয় নয় করে ৪২%। ফারাকটা অচিরে আরও বাড়বে বলেই রাজ্য প্রশাসন-সূত্রের ইঙ্গিত। অথচ ক্ষমতায় আসা ইস্তক মেলা-খেলা-উৎসবে শত শত কোটি টাকা ওড়ালেও বকেয়া ডিএ মেটানোর ক্ষেত্রে মমতার সরকার কেন টাকার অভাবের কথা বলছে, তা নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে।

পানাগড়ে মাটি উৎসবের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

পানাগড়ে মাটি উৎসবের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩০
Share: Save:

মাইনে বাড়াতে না-পারার দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপিয়ে আড়াল খোঁজার চেষ্টা। পাশাপাশি, নতুন দশ লক্ষ ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থানের ঘোষণা। বুধবার পানাগড়ে মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ হেন বক্তৃতা শুনে বিরোধী তো বটেই সরকারের অন্দরেই বিভ্রান্তি চরমে।

এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘভাতার ব্যবধান নয় নয় করে ৪২%। ফারাকটা অচিরে আরও বাড়বে বলেই রাজ্য প্রশাসন-সূত্রের ইঙ্গিত। অথচ ক্ষমতায় আসা ইস্তক মেলা-খেলা-উৎসবে শত শত কোটি টাকা ওড়ালেও বকেয়া ডিএ মেটানোর ক্ষেত্রে মমতার সরকার কেন টাকার অভাবের কথা বলছে, তা নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। বস্তুত, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যেখান থেকে কথাগুলো বলেছেন, সে-ও এক উৎসবেরই মঞ্চ! বকেয়া ডিএ নিয়ে তৃণমূলের কর্মী সংগঠনও বিড়ম্বনা লুকোতে পারছে না। উপরন্তু সরকারের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষুব্ধ কর্মীদের কাছে টানতে মঙ্গলবারই বৈঠক করেছে বিজেপি।

এই অবস্থায় কর্মীদের ন্যায্য বকেয়া দিতে না-পারার দায় এ বার সরাসরি কেন্দ্রের উপরেই চাপালেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং একই মঞ্চে তাঁর মুখে নতুন কর্মসংস্থানের ঘোষণা শুনে বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘দ্বিচারিতা’র অভিযোগ তুলেছেন। কী বলেছেন মমতা? এ দিন পানাগড়ে ‘মাটি উৎসব’-এর সূচনা করে তিনি বলেন, “আমারও তো খুব ইচ্ছে করে, আপনাদের (সরকারি কর্মীদের) মাইনে বাড়ুক। বিশ্বাস করুন, আমি এর পক্ষে, বিরুদ্ধে নই। কিন্তু ওরা (কেন্দ্রীয় সরকার) ২৮ হাজার কোটি টাকা কেটে নিয়ে চলে গিয়েছে! ২০১১-১২ সালে ২১ হাজার কোটি কেটে নিয়ে যায়। অথচ দশ লক্ষ ছেলেমেয়েকে চাকরি দিলে ২০ হাজার কোটি টাকায় তাদের মাইনে হয়ে যেত!” এর পরেই পুরনো অভিযোগের রেশ টেনে মুখ্যমন্ত্রী আক্ষেপ করেন, “সিপিএম কেন্দ্রের কাছে রাজ্যটাকে বিক্রি করে গিয়েছে। তার দায় আমাকে বইতে হচ্ছে।” পাশাপাশি নিজের সরকারের সাফল্য হিসেবে তাঁর দাবি, “২০১১ সালে আমাদের আয় ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। এখন বেড়ে ৪০ হাজার কোটি হয়েছে। আমাদের সরকার খুব ভাল চলছে।”

পানাগড়ের বিরুডিহায় মাটি উৎসবের মঞ্চে মমতা।
বুধবার বিকাশ মশানের তোলা ছবি।

এখানেই না-থেমে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যে কর্মসংস্থানের জোয়ার আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে মুুখ্যমন্ত্রী। “লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। সে কথা কাল আসানসোলে বলব।” জানান মমতা। বলেন, “ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিট থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। আগামী দিনে রাজ্যে বহু শিল্প হবে। আমরা দশ লক্ষ ছেলেমেয়ের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং করাব।” শ্রোতাদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী, “আপনাদের যোগ্যতা আছে, কিন্তু একটা বিশেষ যোগ্যতা থাকলে সুবিধা হয়। আমরা বিনা পয়সায় করিয়ে দেব। দু’-তিন বছরে প্রচুর কাজের সুযোগ আসবে।” রাজ্যের যুবক-যুবতীদের কাজের সুযোগ করে দিতে তাঁর সরকার এ যাবৎ কতটা সফল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানিয়েছেন, “এই ক’বছরে দু’লক্ষ সরকারি চাকরি দিয়েছি। আরও কয়েক লক্ষকে প্রাইভেটে ঢুকিয়েছি।”

পানাগড় মাটি উৎসবের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
বুধবার সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

মুখ্যমন্ত্রীর এই সব দাবি-ঘোষণা-প্রতিশ্রুতিকে প্রশাসনের অনেকেই অবশ্য ভোটের আগের বছরে ‘ভোল পাল্টানো’-র চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ছিল, ক্ষমতায় আসার ক’মাসের মধ্যে তাঁর সরকার ৯০% কাজ করে ফেলেছে। পরে একই দাবি তাঁর মুখে বহু বার শোনা গিয়েছে। যেমন শোনা গিয়েছে, গত সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে দু’লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের তথ্য, যা এ দিনও প্রতিধ্বনিত হয়েছে পানাগড়ের মঞ্চে। “এ দিকে ক’মাস পরে পুরভোট। বছর ঘুরলে বিধানসভা ভোট। কিন্তু মমতা এখন বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, এ সব বলে ফের ভোট চাইতে গেলে লোকে তাঁর দাবিগুলো যাচাই করতে চাইবে।” পর্যবেক্ষণ এক প্রশাসনিক আধিকারিকের।


সবিস্তার জানতে
ক্লিক করুন।

তাই মুখ্যমন্ত্রী এখন থেকেই সরকারি কর্মীদের বেতন না-বাড়ার দায় কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপাতে শুরু করেছেন বলে নবান্নের অন্দরে গুঞ্জন উঠেছে। সরকারি সূত্রের খবর: সরকারি কর্মী, শিক্ষক, পুরসভা ও পঞ্চায়েত মিলিয়ে প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ কর্মীকে বেতন ও কয়েক লক্ষ অবসরপ্রাপ্তকে পেনশন জোগাতে সরকারের ফি বছর খরচ হয় প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি রাজ্য যে ৭% ডিএ ঘোষণা করেছে, তার পরেও কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘভাতার ব্যবধান ৪২%। এর পর কেন্দ্র ডিএ বাড়ালে ব্যবধান আবার বাড়বে।এত ডিএ বাকি রেখে কী ভাবে নতুন দশ লক্ষ কর্মসংস্থানের কথা মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না প্রশাসনের কর্তারা। কর্মীদের বাড়তি বেতন দিতে না-পারার কারণ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর যে যুক্তি, প্রশাসনের একাংশ তা-ও মানতে নারাজ। এই মহলের পাল্টা যুক্তি: তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময় রাজ্যের ঘাড়ে ঋণ ছিল ১ লক্ষ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। সেটাই বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি। অর্থাত্‌, মমতার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে ঋণ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। “তা ছাড়া তৃণমূল যেমন ঋণের বোঝা নিয়ে সরকারে এসেছে, ’৭৭ সালে বামেরাও তো তেমন ঋণের বোঝা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল।” মন্তব্য এক জনের।

প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনায় মুখর হয়েছে বিরোধীরা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা হয় না। মেলা-খেলা-মোচ্ছব, নীল-সাদা রং, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতাদানে যে ভাবে টাকা ওড়ানো হচ্ছে, তা দেখে কে বলবে যে, সরকারের টাকা নেই?” রাহুলবাবু মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী যদি বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতেন, তা হলে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-ও দিতে পারতেন, মাইনেও বাড়াতে পারতেন। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, “এ রাজ্যে এখন রাজা-রানির সরকার চলছে। কর্মসংস্থান শিকেয় তুলে উত্‌সব হচ্ছে! উনি অসত্য কথা বলেই চলেছেন।” কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আংশিক সত্য। কারণ উনি জানতেন, সিপিএম রাজ্যটাকে দেউলিয়া করে গিয়েছে। সব কিছু জেনেও শিল্পস্থাপন করে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার বদলে পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে, মেলা-উত্‌সবে টাকা খরচ করে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা আরও জটিল করে তুলেছেন।”

অন্য বিষয়গুলি:

panagarh mamata bandopadhay mati utsav
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE