নিজেদের প্রচুর টাকা পড়ে থাকছে রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের কাছে। অথচ সংসার চালাতে হচ্ছে ব্যাঙ্কঋণ নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে এই বিচিত্র পরিস্থিতি চলছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থায়। এর ফলে বণ্টন সংস্থার সঙ্কট চরমে তো উঠছেই। সেই সঙ্গে বাড়তি বোঝা চাপছে সাধারণ মানুষের উপরে। কারণ, আখেরে বণ্টন সংস্থার ঋণের দায় বইতে হচ্ছে গ্রাহকদেরই।
এমন অবস্থা কেন? দেদার বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে সরকারের বিভিন্ন দফতর। কিন্তু সময়মতো বিল মেটাচ্ছে না। বকেয়া বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, চলতি আর্থিক বছরে সরকারি দফতরগুলির কাছে পাওনার পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে আছে বিদ্যুৎ চুরির সমস্যা। বিদ্যুৎ চুরি আর বকেয়ার যৌথ হানায় রাজস্ব-ঘাটতির বহর বাড়ছে। সংস্থার পরিচালন পর্ষদের দেওয়া তথ্য বলছে, বণ্টন এলাকার ১০০টি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রে আর্থিক লোকসান হচ্ছে ৬০ শতাংশ (বিদ্যুৎ চুরি মূল কারণ, তবে দুর্বল পরিকাঠামোও অন্যতম কারণ। একে ‘টেকনিক্যাল লস’ বলে)। অর্থাৎ ১০০ টাকার বিদ্যুৎ দিলে ঘরে আসছে ৪০ টাকা। আর আগামী মার্চের শেষে বিভিন্ন দফতরের কাছে পাওনা দাঁড়াচ্ছে ৮০৮ কোটি টাকা।
এখানেই শেষ নয়। সাধারণ গ্রাহক সময়ে বিল না-দিলে জরিমানা করে বিদ্যুৎ সংস্থা। পুরসভা বা সরকারি দফতরের ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থা চালু আছে। বণ্টন সংস্থার খবর, বিল মেটাতে দেরি করায় বিভিন্ন সরকারি দফতরের জরিমানা পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেটা ধরলে বকেয়া দাঁড়ায় ১১০০ কোটি!
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের গ্রামে-শহরে বিদ্যুৎ চুরি তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। তবু লোকসানের বহর বাড়িয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থায় খোদ সরকারেরই বিভিন্ন দফতর কেন বিদ্যুৎ ব্যবহার করে টাকা বাকি রাখবে?
সরকারি কর্তাদের কাছে এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর নেই। গা বাঁচাতে প্রত্যেকেই ‘বিষয়টি দেখা হচ্ছে’ বলে দায় এড়িয়েছেন। আতান্তরে পড়েছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। কারণ, বিদ্যুৎ চুরি হলে বা ব্যবহার করে বিল বাকি রাখলেও সংযোগ কেটে দেওয়ার দাওয়াই প্রয়োগে নবান্নের কর্তাদের তেমন সায় নেই। তাই বণ্টন সংস্থা বুঝেই উঠতে পারছে না, এমন অবস্থায় তাদের করণীয় কী! তাঁদের অবস্থা কত করুণ, তা বোঝাতে গিয়ে বণ্টন সংস্থার এক কর্তা জানান, দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড (ডিপিএল)-এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যত বন্ধ। অথচ ওই সংস্থার অধীন এলাকায় নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে তাঁদেরই!
শুধু যে পাওনার পাহাড় জমছে তা তো নয়। রাজ্যের এক বিদ্যুৎকর্তা জানান, বিলের টাকা সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না বলে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। অর্থাৎ নিজেদের টাকা অন্যের ঘরে পড়ে থাকছে আর সংসার চালাতে হচ্ছে ধার করে! এতে সংস্থার ঋণের বোঝা তো বাড়বেই। সঙ্গে সুদ দিয়ে ধার করে সংসার চালানোর দায় পরোক্ষে পড়বে গ্রাহকদের ঘাড়েই। কারণ, সুদের টাকা তুলতে হয় গ্রাহকদের বিদ্যুৎ-মাসুল বাড়িয়ে। গত ডিসেম্বরের শেষে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কাছে বণ্টন সংস্থার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এবং বণ্টন সংস্থার ইঙ্গিত, এই টাকা গ্রাহকদের মাসুল বাড়িয়েই তোলার চেষ্টা হবে।
সরকারের কোন কোন দফতর বিল বকেয়া ফেলে রাখছে? বণ্টন সংস্থার খবর, রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, ক্ষুদ্রসেচ এবং অন্য কয়েকটি দফতরের কাছেই সব চেয়ে বেশি টাকা পাওনা। বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। সব থেকে বেশি বাকি ফেলে রেখেছে পুরসভাগুলি। তারা নানা অজুহাতে টাকা মেটাচ্ছে না। ওই সব পুরসভার প্রশ্ন, সরকার যদি নিজেদের কোষাগার থেকে কলকাতা পুরসভার বিদ্যুৎ বিল মেটাতে পারে, তা হলে তাদের টাকা দেবে না কেন? এই নিয়ে সরকারের সঙ্গে পুরসভাগুলির দীর্ঘ টানাপড়েন চললেও ফয়সালা হয়নি। কিন্তু লাইন কাটার দাওয়াই প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ জুগিয়েই যেতে হচ্ছে। বিদ্যুৎকর্তারা জানান, জরুরি পরিষেবা ক্ষেত্রে যেমন লাইন কাটা যায় না, দফতরগুলির ক্ষেত্রেও তা-ই। বিল না-মেটালেও বিদ্যুৎ দিতে হচ্ছে।
বিভিন্ন দফতর বিদ্যুতের বিল বাকি রাখছে কেন? সরাসরি জবাব এড়াচ্ছে কিছু দফতর। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “আমার দফতরের খুব বেশি বিল বাকি নেই। থাকলে তা মেটানো হবে।” ক্ষুদ্রসেচ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে বিল মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেক বিল ভুলে ভরা। তার টাকা দেওয়া হচ্ছে না। এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে নারাজ বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান নারায়ণস্বরূপ নিগম। তাঁর কথায়, “কয়েকটি দফতরের কাছে একটু বেশি বিল বকেয়া রয়েছে। তবে কথা চলছে। মিটে যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy