Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
তৃণমূলে ক্রমেই ছড়াচ্ছে বিদ্রোহের সুর

ব্যাখ্যা দিয়েও বেলাইন দেবব্রত, সঙ্গী সব্যসাচী

এক জন দলের নির্দেশ পেয়েও বিদ্রোহের সুর পুরোপুরি ঝেড়ে ফেললেন না! অন্য জন দলে বিদ্রোহীর তালিকায় জুড়ে ফেললেন নিজের নাম! এক জন রাজ্যসভার সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য জন রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী, দুই মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়, দুই বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় এবং স্বপন ঘোষ থেকে শুরু করে দেবব্রত, সব্যসাচী...।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৫
Share: Save:

এক জন দলের নির্দেশ পেয়েও বিদ্রোহের সুর পুরোপুরি ঝেড়ে ফেললেন না! অন্য জন দলে বিদ্রোহীর তালিকায় জুড়ে ফেললেন নিজের নাম!

এক জন রাজ্যসভার সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য জন রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত।

সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী, দুই মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়, দুই বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় এবং স্বপন ঘোষ থেকে শুরু করে দেবব্রত, সব্যসাচী...। সারদা কেলেঙ্কারিতে ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়া তৃণমূলের নীতির বিরুদ্ধে মুখর হওয়া নেতার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ছড়ি ঘুরিয়েও তাঁদের বাগে রাখতে পারছেন না দলের শীর্ষ নেতৃত্ব!

শুক্রবার সারদা-কাণ্ডে জড়িতদের দল থেকে বের করে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন দেবব্রতবাবু। কিন্তু একই সঙ্গে বলেছিলেন, “কে বাদ দেবে তাঁদের? যাঁর দেওয়ার কথা, তিনিই তো রাজা হয়ে গিয়েছেন! একনায়কতন্ত্রী হয়ে গিয়েছেন!” সরাসরি নাম না-করলেও তাঁর মন্তব্যের লক্ষ্য যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা বুঝতে বাকি ছিল না কারও।

আর শনিবার সারদা-কাণ্ডে মুকুল রায়কে সিবিআইয়ের তলব নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সব্যসাচী বললেন, “ব্যক্তি মুকুল রায় বলে নয়, তদন্তের স্বার্থে যে কাউকে ডাকা হতে পারে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তদন্তের বিরোধী নই।” কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি সিবিআই-কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে, এই অভিযোগ তুলে অনেক দিন আগে থেকেই সরব হয়েছেন মমতা। তাঁর নির্দেশে রাস্তায় নেমে ধর্না থেকে মিছিল সবই করেছে তৃণমূল। কিন্তু প্রতিবাদের এই পথ যে তাঁর পছন্দ নয়, তা বুঝিয়ে দিয়ে সব্যসাচী এ দিন বলেছেন, “তদন্ত করতে গিয়ে কোনও সংস্থা যদি বেআইনি কিছু করে, তা হলে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট আছে। দেশে বাস করব, আর সংবিধানকে মানব না, এটা তো হতে পারে না। তা ছাড়া, তদন্তে ডাক পড়া মানেই তো আসামি হয়ে যাওয়া নয়!”

সব্যসাচীর এহেন মন্তব্য নিয়ে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “উনি কী বলেছেন, তা পুরোপুরি জানি না। কিন্তু এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করা দরকার।”

দেবব্রতবাবুরও মুখ বন্ধ করতে শুক্রবার রাত থেকেই সক্রিয় হয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। প্রবীণ সাংসদের সঙ্গে কথা বলার ভার দেওয়া হয়েছিল দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনকে। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ‘সমস্যা মিটিয়ে’ ফেলবেন। সেই মতো শনিবার দেবব্রতবাবুর সঙ্গে কথা বলেন ডেরেক। আর তার পরেই নিজেকে তৃণমূলের ‘সৈনিক ও দলের একনিষ্ঠ কর্মী’ হিসেবে অভিহিত করে বিবৃতি দিয়ে দেবব্রতবাবুর দাবি, “আমার মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে।” ডেরেকও বলেন, “দেবব্রতবাবুর এ দিনের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সুতরাং এই ঘটনা এখন ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’। দলও এই ঘটনাকে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা বলে মনে করছে না।”

কিন্তু আগের দিন যা বলেছিলেন, তার সবটাই কি এ দিন ফিরিয়ে নিলেন দেবব্রতবাবু? তাঁর বিবৃতি কিন্তু সে কথা বলছে না। দেবব্রতবাবু বলেছেন, “আমি যা বলতে চেয়েছি তা হল, একটি গণতান্ত্রিক দলে নানা মতাধিকারী থাকতেই পারে। আমি আমার বক্তব্য সব দলের জন্যেই বলেছি। আমরা যাঁরা রাজনীতির বাইরে থেকে এসেছি, তাঁদের ভবিষ্যতে কোনও বক্তব্য রাখার আগে সাবধান হওয়া উচিত। কারণ আমাদের সাধারণ বিবৃতিরও ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। আমি দলের নেতৃত্বের দিকে কোনও আঙুল তুলিনি।”

কিন্তু ২৪ ঘণ্টা আগে যে রাজার কথা বলেছিলেন, তিনি তা হলে কে? এ দিন দেবব্রতবাবু বলেন, “সেটাও যে কোনও দলেই হতে পারে! এই তো হাতের কাছে উদাহরণ আছে। সিপিএম। একনায়কতন্ত্রী পথে চলতে গিয়ে ধূলিসাৎ হয়েছে।” তৃণমূলের একটা অংশ বলছে, আসলে সিপিএমে একনায়ক আছে বলে কথা ঘুরিয়েছেন দেবব্রতবাবু। মমতা একনায়ক নন, এমনটা জোর দিয়ে বলেননি এ দিনও। দলীয় লাইন মানলে যেটা করা যুক্তিযুক্ত হতো।

সারদা-কাণ্ডকে ‘অনভিপ্রেত’ আখ্যা দিয়ে শুক্রবার দেবব্রতবাবুু বলেছিলেন, “ক্ষমতায় থাকলে কিছু ভ্রমর ঘুরবে। ডাঁশ মশা ঘুরবে। এদের থেকে বেঁচে চলতে না পারলে অসুবিধা তো হবেই।” এ দিন এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাতে তাত্ত্বিক মোড়ক দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “শুধু সারদা কেন, আরও কত কাণ্ড তো চার দিকে ছড়িয়ে আছে!... এটা তো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বলেছি। কোনও নির্দিষ্ট দলকে নিয়ে বলিনি। এর সঙ্গে তৃণমূল বা তাদের নেতৃত্বের কোনও সম্পর্ক নেই।” কিন্তু তৃণমূল শীর্ষ নেতাদের একাংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী যখন জোর গলায় দাবি করে যাচ্ছেন তৃণমূলের চেয়ে সৎ দল গোটা দেশে একটাও নেই, তখন দলীয় লাইন মেনে এটাই বলা উচিত ছিল যে, এমন উপসর্গ রাজ্যের শাসক দলকে গ্রাস করেনি। দেবব্রতবাবু সেই পথে হাঁটেননি। ওই নেতাদের মতে, আসলে দলীয় নেতৃত্বের দিকে যে আঙুল দেবব্রতবাবু তুলেছেন, দলের চাপে খানিকটা নরম হলেও তা পুরোপুরি নামিয়ে ফেলেননি।

দেবব্রতবাবুর মতো অবস্থান নিয়েছেন দলের অন্য বিদ্রোহী নেতারাও। দলীয় নীতির সমালোচনা করে ভর্ৎসিত হওয়ার পরে সাধন পাণ্ডে যেমন বলেছেন, “শুভবুদ্ধি চেপেই দলের লাইনে আছি।” আর এক বিদ্রোহী দীনেশ ত্রিবেদীকে লাইনে আনার ভার দেওয়া হয়েছিল দলের এক প্রবীণ সাংসদকে। দীনেশবাবু তাঁর অনুরোধ রাখতে রাজি হননি। সেই সাংসদও দীনেশবাবুকে বলেছেন, তাঁকে দলের তরফে বলতে বলা হয়েছিল বলে তিনি বলছেন। এ বার দীনেশবাবু কী করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার।

এহেন বাতাবরণে বিধায়ক সব্যসাচীও কেন বিদ্রোহের ধ্বজা তুললেন, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। দলের নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, রাজারহাট-নিউটাউন এলাকায় সিন্ডিকেট চক্র নিয়ে সব্যসাচীর গোষ্ঠীর সঙ্গে দলের অন্য গোষ্ঠীর সংঘাত তুঙ্গে। এমনকী, সম্প্রতি বিধাননগর মেলা নিয়ে স্থানীয় পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর সঙ্গেও বিবাদ-বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার থেকে শুরু করে একাধিক বিধায়কের সঙ্গে সব্যসাচীর বিবাদ সামাল দিতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ মমতাকে। সেই সব বিবাদ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দলীয় নেতৃত্বের সব সিদ্ধান্ত সব্যসাচীর মনমতো হয়নি। এখন সুযোগ বুঝে সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, সব্যসাচীর বক্তব্যের সারবত্তা নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন তুলতে পারেননি তৃণমূল নেতারা। তাঁদের একাংশের স্বীকারোক্তি, সারদা-কাণ্ডকে তো সাধারণ বুদ্ধিতে সমর্থন করা সম্ভব নয়। ফলে এই কেলেঙ্কারি ঘিরে দলের অবস্থান নিয়ে ক্রমশ অসন্তোষ মাথাচাড়া দিচ্ছে। আর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পায়ের তলার মাটি যত আলগা হচ্ছে, ততই প্রকাশ্যে আসছে বিদ্রোহী স্বর।

সব্যসাচী-দেবব্রতর জোড়া ফলার মুখে এ দিন তৃণমূলকে অবশ্য কিঞ্চিৎ স্বস্তি দিয়েছেন বিজেপি সাংসদ, প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ। মমতার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের উল্লেখ করে কীর্তি বলেছেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না মমতাদি অসৎ।” কীর্তির এই মন্তব্য নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে, সংবাদমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে ফলাও করে প্রচারে নেমেছে তৃণমূল। যা দেখে দলেরই এক প্রবীণ নেতার মন্তব্য, “কীর্তি আজাদ তো বিজেপির তেমন দরের কোনও সাংসদ নন। অথচ তাঁর মন্তব্যই আমাদের খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে! কী দৈন্য দশা!”

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ স্বাভাবিক ভাবেই কীর্তির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত নন। তাঁর বক্তব্য, ওটা কীর্তির নিজস্ব মতামত। একই সঙ্গে সিদ্ধার্থনাথের অভিযোগ, সিবিআই তদন্ত এড়াতে চাইছেন বলেই মুকুলের মতো নেতারা ঘনঘন দিল্লি যাচ্ছেন। ঘটনাচক্রে এ দিন বিকেলেই দিল্লি রওনা হন মুকুল। কলকাতা ছাড়ার আগে তিনি বলেন, “পার্টির মামলা (সারদা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে) আছে ২৭ তারিখে। সুতরাং সেই মামলার জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হচ্ছে। সে জন্য এক দিন আগেই আমি দিল্লি যাচ্ছি।”

আর সিদ্ধার্থনাথের মন্তব্য, “আমরা ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ যে স্লোগান দিয়েছি, তা ভুল প্রমাণ করতে মুকুলের উচিত সিবিআইয়ের সামনে হাজির হওয়া।”

অন্য বিষয়গুলি:

debabrata bandyopadhyay TMC sabyasachi dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE