ব্যাঙ্কশাল আদালতে কুণাল ঘোষ। বুধবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
কুণাল ঘোষের বচন-বাণের মোকাবিলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সুর বদলালেন মুখ্যমন্ত্রী।
যাদবপুর কাণ্ড নিয়ে মুখ খুলে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন আগেই। দলের কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি শিবির বদল করতে পারেন এমন জল্পনাও বিস্তর। সুব্রতবাবুর উপরে নজর রাখতে তাই মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে মন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে জুড়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবার মওকা বুঝে মমতাকে বিঁধতে সুব্রতবাবুকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে বসলেন তৃণমূল থেকে সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষ। সেই প্রশংসা দলের বিভাজনকে আরও গভীর করতে পারে আন্দাজ করে উল্টো পথে হাঁটলেন মমতাও। মাটি উত্সবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভূয়সী প্রশংসা করলেন সুব্রতবাবুর।
সুব্রতবাবুকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে যে জলঘোলা হচ্ছে, সে খবর বিলক্ষণ রাখেন জেলবন্দি কুণাল। এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতে হাজিরা সেরে বাইরে বেরিয়ে সেই ঘোলাজলেই মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধতে চেয়েছেন তিনি। মমতার নাম না-করেই বলেছেন, যত দিন না সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত শেষ হচ্ছে, তত দিন অভিযুক্তদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত। মমতার জায়গায় কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা-ও এ দিন ঠিক করে দিয়েছেন কুণাল। তাঁর বক্তব্য, “যত দিন না তদন্ত শেষ হচ্ছে, তত দিন সুব্রত মুখোপাধ্যায় যোগ্যতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার চালান!”
দল ও সরকারের কাজকর্মে রুষ্ট হয়ে যে সব নেতা-মন্ত্রী ইদানীং মুখ খুলেছেন সুব্রতবাবু তাঁদের অন্যতম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে সার্টিফিকেট নিতে অস্বীকার করা ছাত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ছে বলে তৃণমূল সূত্রেই খবর। অনেকে এ-ও বলছেন যে, তেমন বুঝলে দল বদলের ভাবনাও রয়েছে সুব্রতবাবুর। বর্ষীয়ান এই মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব আরও স্পষ্ট করে দিয়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই সুব্রতবাবুর পঞ্চায়েত দফতরের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প দেখভালের জন্য প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে জুড়ে দিয়েছেন মমতা। কিন্তু কুণালের মন্তব্য সব অঙ্ক পাল্টে দিয়েছে। তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, সুব্রতবাবুকে কেন্দ্র করে দলে ‘অন্য রকম’ ভাবনা যাতে মাথাচাড়া না-দেয় সে জন্যই পানাগড়ের মাটি উত্সবের অনুষ্ঠানে সম্পর্কের শীতলতা কাটানোর চেষ্টা করেছেন মমতা। এগিয়ে দিয়েছেন চায়ের কাপ! সুব্রতবাবুও তাঁর বক্তব্যে ‘মমতা ম্যাজিক’-এর কথা বলেছেন।
বহু যুদ্ধের সৈনিক সুব্রতবাবু বিলক্ষণ জানেন, কোনও প্রশস্তিই অহেতুক নয়! কুণালের কৌশল, সুব্রতবাবুর নাম ‘যোগ্যতম মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে ভাসিয়ে দিয়ে তৃণমূলের মধ্যে আরও অবিশ্বাসের বাতাবরণ বাড়ানো! আবার তৃণমূল নেত্রীর লক্ষ্য, দলের অভিজ্ঞ এক সেনাপতিকে বেশি রুষ্ট হতে না দেওয়া। পরস্পরের এই কৌশল জানেন বলে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অবিচলিত থাকারই চেষ্টা করেছেন সুব্রতবাবু। তৃণমূলে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতার মন্তব্য, “সুব্রতদার কপাল এমন, বাইরের লোক (কুণাল) সার্টিফিকেট দিচ্ছে, কিন্তু ভিতরে তাঁকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে!” কিন্তু সুব্রতবাবু নিখুঁত অঙ্কে কুণালের কথায় গুরুত্বই দিতে চাননি! বলেছেন, “ও গুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি করছে! ও যেখানে আছে, সেখান থেকে ওর কথায় কোনও কাজও হবে না!”
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত শুরুর পর মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বারেবারেই মুখ খুলেছেন কুণাল। তাঁর মুখ বন্ধ করতে কখনও হা-রে-রে-রে শব্দ করেছে পুলিশ। কখনও ধাঁই-ধপাধপ গাড়ি বাজিয়েছে! ব্যাঙ্কশাল আদালত চত্বরে তাঁর গলা টিপে ধরার নজিরও আছে। কিন্তু তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে এ দিন কুণাল যখন প্রকারান্তরে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করছেন, পুলিশি সক্রিয়তা চোখে পড়েনি। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কি তবে জেনেবুঝেই কুণালকে মুখ খুলতে দিল?
সকালে অবশ্য পুলিশের ভূমিকা ছিল আগের মতোই। আদালতে আনার সময় অন্য দিনের মতোই শারীরিক শক্তি দিয়ে কুণালের মুখ আটকানোর প্রচেষ্টা ছিল তাদের। কেন? পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন সকালেই কুণাল প্রেসিডেন্সি জেল থেকে আদালতে আসার পথে বেঁকে বসেছিলেন।মদন মিত্রকে কেন বোলেরো গাড়িতে চাপিয়ে আদালতে নেওয়া হচ্ছে এবং তাঁর বেলায় কেন পুলিশের ভ্যান, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বেগতিক দেখে জেলে গিয়ে কুণালের সঙ্গে কথা বলেন ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা এবং ডিসি (রিজার্ভ ফোর্স) অশেষ বিশ্বাস। নগর দায়রা আদালতের বিচারক অরবিন্দ মিশ্রকে কুণাল জানিয়েছেন, কলকাতা পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট। এ নিয়ে ডিসি-দের কাছে তিনি চার দফা দাবি পেশ করেছেন। তাতে সুরাহা না হলে লিখিত ভাবে আদালতের হস্তক্ষেপ চাইবেন।
লালবাজারের একাংশের ব্যাখ্যা, এ দিন কার্যত কথার জালে পুলিশকে বোকা বানিয়েছেন কুণাল! আদালতে পৌঁছনোর পথে এবং এজলাসে শাসক দলের বিরুদ্ধে সে ভাবে আক্রমণই করেননি। বরং আদালতে পৌঁছনোর পরে গাড়ি থেকে নামার সময় কয়েক জন পুলিশকর্মীর অতি-সক্রিয়তা দেখে বলেন, “এমন করছেন কেন? আমি তো কিছুই বলব না!” কোর্ট লক-আপ থেকে এজলাসে যাতায়াতের পথে পুলিশের একাংশের কাছে নিজেকে সাচ্চা তৃণমূলকর্মী বলে দাবি করে অসমের কংগ্রেস নেতাকে নিয়েই কথা বলে গিয়েছেন কুণাল। অসমের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সে রাজ্যের বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অঞ্জন দত্তকে বাঁচাতেই কপিল সিব্বল সারদা-মামলা লড়ছেন, এমন দাবিও করেছেন। যার জবাবে অঞ্জনবাবু বলেছেন, “যা বলার, সিবিআইকে বলেছি। সিব্বলকে দলের নেতা হিসাবে চিনি। কুণালকে আমি চিনিও না। উনি এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ কেন করছেন, জানি না!”
কুণালের এই রূপ দেখেই পুলিশ সম্ভবত ভেবেছিল তাঁর মতিগতি বদলেছে। জেলের গাড়িতে ওঠার সময়েও তিনি বলতে থাকেন, বনগাঁ উপনির্বাচনে তৃণমূলই জিতবে। এ সব দেখেই একটু ঢিলে দিয়েছিল পুলিশ। আর সেই সুযোগেই কুণাল বলে দেন, “সারদা তদন্ত একেবারেই আলাদা। তবে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা ইস্তফা দিয়ে তদন্তের মুখোমুখি হয়ে সরকারে ফিরে যান। আর তত দিন যোগ্যতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সরকার চালান!” যা শুনে শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “কুণালের মুখে ওঁর নাম এল মানে সুব্রতদার কপাল আরও পুড়ল!”
পানাগড়ের মাটি উত্সবে অবশ্য দৃশ্যত আগুনের কোনও আঁচ ছিল না! মঞ্চের মাঝের আসনে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর ডান পাশেই সুব্রতবাবু। বক্তব্য রাখতে উঠে সুব্রতবাবু বলেন, “তিন বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী হঠাত্ তাঁর চেম্বারে ডেকে বলেছিলেন মাটি উত্সব করতে হবে। হাতে ৬ দিন সময়। ঘোর দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই! কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ম্যাজিকে যেন সব হয়ে গেল!” তিনি দাবি করেন, যে ভাবে বর্তমান সরকার কৃষকদের সম্মান জানাচ্ছে, অতীতে কোনও সরকার তা করেনি। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। সুব্রতবাবু বক্তব্য শেষ করে বসা মাত্র মমতা নিজের চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সুব্রতবাবুকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেন।
সৌহার্দ্যের ছবি এখানেই শেষ নয়। এর পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, “মাটিই তো সব। তিন বছর আগে ভেবেছিলাম, একটা মাটি উত্সব করা যায় না! সুব্রতদা আমায় বলেছে, তুই আমাকে মাত্র ৬ দিন সময় দিয়েছিলি!” মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, বাংলার দেখানো পথেই রাষ্ট্রপুঞ্জ চলতি বছরকে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, “আমরা যা তিন বছর আগে শুরু করেছিলাম আজ তা বিশ্বজনীন। এটাই বিশ্ববাংলা।” তা শুনে সুব্রতবাবুকে হাততালি দিতে দেখা যায়। বেচারামের সঙ্গে অবশ্য সুব্রতবাবুকে কথা বলতে দেখা যায়নি।
তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না! সক্কলে জানে, মুখ্যমন্ত্রীই সব! ব্যাপার দেখে রাজ্যেরই এক মন্ত্রী বলছেন, “এ তো শেয়ার বাজার! আজ নম্বর পড়ছে, কাল উঠছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy