শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকেই বিজেপি বিরোধী সুরটা চরমে তুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
বিজেপিকে প্রবল আক্রমণ।
বামেদের সম্পর্কে কখনও নরম, কখনও গরম।
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুখ না খোলা।
চুম্বকে এই রকম ভাবেই ‘শহিদ দিবস’এ দেখা গেল মমতাকে।
বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর তিনি অনেক দিন ধরেই চড়াচ্ছেন। কিন্তু সেই সুরটাকে তিনি চরমে পৌঁছে দিলেন দলের শহিদ স্মরণ সমাবেশের মঞ্চ থেকেই। অন্য যে কোনও বছরের মতো এ বছরও ২১ জুলাইতে বড়সড় জমায়েতই দেখল ধর্মতলা। আর সেই জমায়েতকে সাক্ষী রেখে দলনেত্রীর চ্যালেঞ্জ— ‘২০১৯-এ বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাবই।’
সারদা বা নারদ, কোনও ইস্যুকেই তিনি আর গুরুত্ব দেন না। এ দিনের সমাবেশ থেকে এ কথা খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চক্রান্ত করে তৃণমূলের নেতাদের ফাঁসানো হয়েছে বলে তিনি আগেও জানিয়েছিলেন। এ দিনও ফের সে কথাই বলেছেন। কেন নারদ কাণ্ডের তদন্ত শেষ হতে এত সময় লাগছে? প্রশ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তৃণমূলকে চাপে রাখতেই এই সব মামলা ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে বলে তাঁর ইঙ্গিত। ২১ জুলাইয়ের আগে তৃণমূলকে চাপে ফেলতেই সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ববি হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দেরকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তলব করছে বলে তিনি এ দিন মন্তব্য করেন। এর পরই কেন্দ্রকে তথা বিজেপিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘যত খুশি তদন্ত করুন, যদি এই সব সারদা-নারদ প্রমাণ করতে না পারেন তা হলে হাজার হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলায় আমরাও যাব।’’
গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশ মঞ্চ ছিল তারকাখচিত। ছবি: পিটিআই।
বিজেপি বিপুল অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন অভিযোগ করেন। ডিমনিটাইজেশনের নামেও দুর্নীতি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। গুজরাতে পেট্রোলিয়াম কেলেঙ্কারি, মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারি ইত্যাদির অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন— কেন এই সব অভিযোগের সিবিআই তদন্ত হচ্ছে না?
বিজেপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে বলে এ দিন তৃণমূলের সব বক্তাই অভিযোগ করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীরের গলাতেও সেই সুরই শোনা গিয়েছে। তার প্রেক্ষিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বার্তা দিতে চেয়েছেন, বাংলায় নিজের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিহিংসামূলক আচরণ তিনি কখনও করেন না। ১৯৯৩ সালের যে ২১ জুলাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বছর বছর এই শহিদ স্মরণের আয়োজন করে তৃণমূল, সেই ঘটনার তদন্ত শেষে যে কোনও বাম নেতাকে নিয়ে টানাটানি হবে না, সে কথা মুখ্যমন্ত্রী এ দিন খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুদের আমরা ছোঁব না।’’ কিন্তু ১৯৯৩ সালের সেই মহাকরণ অভিযান কর্মসূচিতে গুলিচালনার ঘটনায় যে পুলিশকর্তাদের নাম উঠে এসেছিল, তাঁরা কেউ ছাড় পাবেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: গোরক্ষকদের কোনও জায়গা নেই দেশে, সুপ্রিম কোর্টে বলল কেন্দ্র
তৃণমূলকে ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ হবে না বলে এ দিন ফের জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৮টি বিরোধী দলের মধ্যে যে সমঝোতা গড়ে উঠেছে, শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে সেই বিরোধী জোটের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি। জাতীয় স্তরে কংগ্রেস, এবং বিভিন্ন রাজ্যে লালু, নীতীশ, অরবিন্দ কেজরীবাল, নবীন পট্টনায়ক, ডিএমকে-র মতো দল যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছে, সে কথা তো তিনি উল্লেখ করেছেনই। সেই সব দলের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন নিজের দল তৃণমূল এবং নিজের প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএমের নামও। মমতা বিজেপিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন— ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই সব দল বিজেপির বিরুদ্ধে নিজের নিজের মতো করে লড়বে। তাঁর কথায়, ‘‘খেলা অত সহজ নয় মোদীবাবু, ২০১৯-এ ৩০ শতাংশ ভোটও পাবেন না।’’ তিনি বলেন, ‘‘বিজেপিকে তাড়াব, একটা সিটও বাংলা থেকে পেতে দেব না, এটা চ্যালেঞ্জ।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘যতই করো সারদা, যতই করো নারদ, ২০১৯-এ বড়দা বিদায় হবেই।’’
সারদা বা নারদ কাণ্ডের তদন্তে তৃণমূলের যে সব নেতাকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তলব করেছে, দল যে তাঁদের পাশেই থাকছে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে এ দিন ফের তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। ছবি: পিটিআই।
‘গো-রক্ষকদের’ বিরুদ্ধেও এ দিন সুর চড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বঘোষিত গো-রক্ষা বাহিনীকে এ দিন তিনি ‘গো-রাক্ষস’ বলে আক্রমণ করেছেন। গো-রক্ষার নামে, ধর্মের নামে বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিভাজন চাইছে বলে মমতা এ দিন ফের সতর্ক করে দিয়েছেন। নিজের দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি মমতার আহ্বান, ‘‘আপনারা পাহারাদার হন, আপনারা আমার সঙ্গে থাকলে, আমি কাউকে ভয় পাই না।’’ সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার বা প্ররোচনা দেখলেই তার প্রতিবাদ করতে দলের কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পুলিশে খবর দিতে বলেছেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে অবশ্য বামেদেরও কিছুটা আক্রমণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, এ রাজ্যে বামেদের সঙ্গে বিজেপির লোকদেখানো লড়াই চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়— ‘‘দিল্লি থেকে এল নকল রাম, আর তার সঙ্গে সিপিএম-বাম।’’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পক্ষে যে ক্রস ভোটিং হয়েছে, বাম বিধায়করাই তা করেছেন বলে তৃণমূলনেত্রীর দাবি। তবে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, বামেরা নয়, তৃণমূলের দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৃণমূল বিধায়করাই ক্রস ভোটিং করেছেন।
শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে দলের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি মমতার আহ্বান, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই আরও তীব্র করতে হবে। ৯ অগাস্ট থেকে ‘বিজেপি ভারত ছাড়ো’ কর্মসূচিতে দলকে পথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের পাল্টা ঘোষণা, ৯ অগাস্ট থেকে বিজেপি-ও পথে নামবে। ‘টিএমসি তোষণ ছাড়ো’ কর্মসূচি পালন করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy