Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
State News

ভদ্রেশ্বরে ভাগাড়ের ভিতরেই কসাইখানা, মরা পশু তুলে মাংস কাটা চলছে এখনও

অবাক হওয়ার শেষ হয়নি এখনও। বৃহস্পতিবার রাতে খবর এল, কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে হুগলির ভদ্রেশ্বরে ভাগাড়ের মধ্যেই নাকি চলে মরা পশুর কসাইখানা! এবং এত কিছু হইচইয়ের পরেও তা বন্ধ হয়নি।

সিজার মণ্ডল
ভদ্রেশ্বর শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৪১
Share: Save:

ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া পশুর ছাল ছাড়িয়ে, পিস পিস করা মাংস চলে যাচ্ছে গাড়িতে চেপে। কলকাতার দিকে। ধরে ফেলার পর চমকে উঠেছিলেন বজবজের সুভাষ উদ্যান এলাকার লোকজন। এ-ও সম্ভব!

তার পর জানা গেল, সেই মাংস খাস কলকাতার বাজারেই টাটকা কাটা মাংসের মধ্যে মিশে যায় ‘নিঃশব্দে’। দেখে-শুনে শিউরে উঠছে সবাই!

কিন্তু, অবাক হওয়ার শেষ হয়নি এখনও। বৃহস্পতিবার রাতে খবর এল, কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে হুগলির ভদ্রেশ্বরে ভাগাড়ের মধ্যেই নাকি চলে মরা পশুর কসাইখানা! এবং এত কিছু হইচইয়ের পরেও তা বন্ধ হয়নি।

দেখুন ভিডিয়ো

শুক্রবার সকালেই রওনা দেওয়া গেল। ভদ্রেশ্বর স্টেশনে নেমে জিটি রোডের দিকে কিলোমিটার দুয়েকের মধ্যেই নেতাজি সুভাষ ময়দান। সেখানেই প্রশাসনের নাকের ডগাতে বসে ভাগাড়ে ফেলা মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে মাংস পাচারের ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। বজবজের ঘটনার পরেও যে হুঁশ ফেরেনি। মাছের খাবারের নামে মরা পশুর মাংস কোথায় যাচ্ছে, জানতেন না কেউই! ভদ্রেশ্বর পুরসভা এলাকায় নেতাজি সুভাষ ময়দান। পুরসভার ‘সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট’-এর গায়েই সরকারি জমিতেই রয়েছে স্থানীয় ভাগাড়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছিল, ওই ভাগাড়ে মরা পশু ফেলা হলেই কিছু মানুষ এসে সেই পশুর চামড়া ছাড়িয়ে, মাংস ও হাড় আলাদা করে নিয়ে চলে যায়। শুক্রবার ওই ভাগাড়ে গিয়ে সেটাই দেখা গেল।

সকাল ১১টা। ভাগাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই নজরে এল, একটি মিনিডোর ভ্যান এসে ঢুকল সেখানে। ত্রিপল চাপা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে মিনিডোরে রয়েছে একাধিক মৃত গবাদি পশু। ভাগাড়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় আবর্জনার পাহাড়ের মাঝে একটা ছোট ঘর। তার সামনে গিয়ে থামল মিনিডোর ভ্যানটি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাইকে করে সেখানে পৌঁছলেন আরও এক যুবক। মিনিডোর থেকে নামিয়ে মৃত পশুদের দেহগুলি ঢোকানো হল ওই ঘরে। তার পর দুই যুবক অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মৃত পশুর ছাল ছাড়িয়ে, হাড় আর মাংস আলাদা করা শুরু করলেন।

পৌঁছনো গেল ওই ঘরে। কে বা কারা কেন এই ঘর এখানে বানিয়েছে, জানা গেল না। মাংস ছাড়াচ্ছেন যে দুই যুবক, তার মধ্যে এক জনের নাম মহম্মদ সামসেদ আলম। কথায় কথায় তিনি বললেন, “আশেপাশে যে কোনও খাটালে কোনও পশু মারা গেলেই আমাদের খবর দেওয়া হয়। কারণ, আমাদের টেন্ডার আছে। আমরা চামড়া ছাড়িয়ে মাংস আলাদা করার জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পাই।” ওই যুবকের কাছেই জানা গেল, চার-পাঁচ দিন পর পরই তাঁদের ডাক পড়ে। চামড়া নিয়ে নেন তাঁদের ‘মালিক’, যিনি টেন্ডার নিয়েছেন। আর মাংস কোথায় যায়? জিজ্ঞাসা করতেই ওই যুবক জানালেন, “আমরা চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার পর, হাড় ও মাংস আলাদা করে দেব। তার পরই গাড়ি আসবে। সমস্ত মাংস নিয়ে যাবে।”

মিনিট দশেকের মধ্যে আরও একটি মিনিডোর এসে পৌঁছল ভাগাড়ের ওই ঘরের সামনে, যেখানে মরা পশুর মাংস ছাড়ানো হচ্ছে। তার পর বড় বড় বালতিতে ভরে মিনিডোরে তোলা হল সেই মাংস। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওই মাংস? মিনিডোর চালক জানালেন, ‘‘মাংস ভর্তি এই গাড়ি যাবে নৈহাটিতে। সেখানে হাইব্রিড মাগুরের চাষ হয়। সেই মাছের খাবার হিসেবেই ওই মাংস ব্যবহার করা হবে।’’

ভদ্রেশ্বরের ভাগাড়। এই মিনিডোরে ভ্যানেই ছিল একাধিক মৃত গবাদি পশু। —নিজস্ব চিত্র।

বজবজেও যখন স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম দিন পুরকর্মী রাজা মল্লিককে তার সঙ্গী-সহ হাতে নাতে পাকড়াও করেছিলেন, তখনও তারা দাবি করেছিল, ওই মাংস তারা মাছের খাবার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, পরে জানা যায়, তারা পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই মাছের খাবারের গল্প করেছিল।

মহম্মদ সামসাদের কাছ থেকেই জানা গিয়েছিল, চাঁপদানির ইয়াসিন ওরফে কালিয়ার নাম। ইয়াসিনের দাবি, মৃত পশুর চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করার টেন্ডার সে পুরসভার কাছ থেকেই নিয়েছে। তাঁরও দাবি, মৃত পশুর মাংস নৈহাটি এবং কল্যাণী এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়, মাছের খাবার হিসেবে।

কিন্তু কিসের জন্য এই টেন্ডার? পুরসভা আদৌ জানে তো মৃত পশুর মাংস কোথায় যাচ্ছে? প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন ভদ্রেশ্বর পুরসভার পুরপ্রধান প্রলয় চক্রবর্তী। তিনি জানান, পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী, ভাগাড়ে ফেলা পশু পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে দিতে হয়। সেখানে এ রকম হওয়ার কথাই নয়। পুরপ্রধানের কথায়, “আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। এ রকম কিছু ঘটে থাকলে ব্যবস্থা নেব।”

বজবজ থেকে নিউটাউন, একের পর এক ঘটনার পরেও পুরসভাগুলোর চোখ খোলেনি। ভদ্রেশ্বরের ঘটনাই তার প্রমাণ। এমন ভদ্রেশ্বর আরও বহু জায়গায় রয়ে গিয়েছে। এখনও রমরমিয়ে চলছে মরা পশুর মাংস পাচার। সত্যিই কি প্রশাসন জানে না? স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানেন না? প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হচ্ছে, প্রতি দিন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE