Advertisement
০৯ নভেম্বর ২০২৪

এত দিনে কামদুনি উন্নয়নে ফের মন রাজ্যের

প্রতিশ্রুতির বন্যা আগেও দেখেছে কামদুনি। ন্যায়বিচারের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে করতে তার দেখা হয়ে গিয়েছে, উন্নয়ন থেকে যায় মুখের কথাতেই। আদালতের রায় শোনার পরে অবশেষে নড়াচড়া শুরু হয়েছে প্রশাসনে। দোরগোড়ায় ভোটের আগে এ বার কামদুনির উন্নয়নের জন্য পাঠানো হচ্ছে জেলা প্রশাসনের বিশেষ দল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:২১
Share: Save:

প্রতিশ্রুতির বন্যা আগেও দেখেছে কামদুনি। ন্যায়বিচারের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে করতে তার দেখা হয়ে গিয়েছে, উন্নয়ন থেকে যায় মুখের কথাতেই। আদালতের রায় শোনার পরে অবশেষে নড়াচড়া শুরু হয়েছে প্রশাসনে। দোরগোড়ায় ভোটের আগে এ বার কামদুনির উন্নয়নের জন্য পাঠানো হচ্ছে জেলা প্রশাসনের বিশেষ দল।

সোমবার রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী ও উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘আগামী রবিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের কর্তারা কামদুনি পরিদর্শনে যাবেন। কামদুনিতে আরও কী কী উন্নয়ন করা যায়, খতিয়ে দেখা হবে। আশপাশের গ্রামগুলিতেও উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’’

অথচ ২০১৩ সালের ৭ জুন কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের সেই নৃশংস ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিক্ষোভে উত্তাল কামদুনি সুবিচারের পাশাপাশি উন্নয়নই চেয়েছিল। বলেছিল, উপযুক্ত রাস্তাঘাট, আলোর ব্যবস্থা এবং পুলিশি নজরদারি থাকলে গ্রামের মেয়েটাকে এ ভাবে মরতে হতো না। কখনও এলাকার সাংসদ ও জেলা তৃণমূল সভাপতির পথ আটকে, কখনও মুখ্যমন্ত্রীর সামনে ক্ষোভ উগরে, কখনও বা গ্রামে ভিড় করে আসা নেতা-মন্ত্রীদের সামনে কামদুনির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অভিযোগ করেছিল, দিনে-দুপুরেই পথ চলতে তাঁদের ভয় করে। প্রশাসন তাঁদের আশ্বস্ত করেছিল। স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি-পাকাপোক্ত রাস্তাঘাট-বাতিস্তম্ভ-উচ্চমাধ্যমিক স্কুল... প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ কিন্তু আজও খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে।

কামদুনি মামলার রায় বেরনোর পরের দিনও কামদুনির প্রতিবাদের অন্যতম মুখ টুম্পা কয়াল আনন্দবাজারের পাতায় লিখেছিলেন, ‘‘যে রাস্তা থেকে আমার বান্ধবীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সেই রাস্তাটার যা হাল!...এই রায়ের ঠিক ক’দিন আগে ক’টা আলো বসেছে। তা-ও গ্রামের ভিতরে এখনও অন্ধকার।’’ সখেদে তাঁর আক্ষেপ ছিল, ‘‘কষ্ট আর বঞ্চনা ছাড়া কামদুনি এই আড়াই বছরে কিছুই পায়নি।’’ এলাকাবাসীদের বড় অংশেরই অভিযোগ, রাজারহাট-খড়িবাড়ি রোড থেকে বাঁ দিকে ঢুকে বারাসত ২ নম্বর বিডিও অফিস পর্যন্ত কামদুনির রাস্তাটি সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা। এই আড়াই বছরে রাস্তাটি সারাই হওয়া দূরে থাক, তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইট, পাথর উঠে মাটি বেরিয়ে পড়েছে। উঁচু-নিচু রাস্তায় প্রায়শই দুর্ঘটনা হচ্ছে। দু’ধারে আলো দেওয়ার কাজ সবে শুরু হয়েছে। এখনও বিস্তীর্ণ পথ অন্ধকারে ডুবে। ম্যাজিক গাড়ি ছাড়া যানবাহনের সুবিধাও বাড়েনি। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল হওয়া দূরে থাক, চালু স্কুলটাই অনুমোদনের অভাবে ধুঁকছে।

পাশাপাশি পুলিশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় সার্বিক ভাবেই এলাকায় নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলে দাবি। বারাসতে রাজীব দাস খুনের ঘটনার পরে থানা ভাগ হওয়া বা রাস্তায় আলো বসা-র মতো কিছু উদ্যোগ দেখতে পেয়েছিলেন এলাকাবাসী। কামদুনির কপাল সে তুলনায় মন্দই থেকে গিয়েছে, এমনই মত বাসিন্দাদের। নিরাপত্তার দাবিতে দু’দিন আগেও টুম্পা-মৌসুমি কয়াল-সহ এলাকার মানুষ বিধাননগর পুলিশ কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন। এ দিনও টুম্পা বলেন, ‘‘সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও গ্রামে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি আজও হয়নি। অস্থায়ী চৌকি যেটুকু রয়েছে, তা-ও যাতে না উঠে যায় তার দাবিতেই আমরা গিয়েছিলাম।’’ মৌসুমী বলেন, ‘‘এলাকা ঘুরলেই তো বোঝা যায় কী হয়েছে আর কী হয়নি। এখানকার মানুষ যদি নিরাপদেই থাকেন, তা হলে আড়াই বছর পরে স্থায়ী ফাঁড়ির দাবিতে স্মারকলিপি কেন দিতে হল?’’

প্রশ্ন হল, আড়াই বছর পেরিয়ে সরকারের হঠাৎ টনক নড়ল কেন? রাজনৈতিক শিবিরের মতে, তৃণমূল-অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠেছিল কামদুনি। তার মধ্যে বিক্ষোভের মুখে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর রোষ এবং প্রতিবাদীদের মাওবাদী বলে দেগে দেওয়ার জেরে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়। রাজ্য জুড়েই প্রতিবাদ আন্দোলন গ়ড়ে ওঠে। এখন আদালতের রায়ে তিন জনের ফাঁসি এবং তিন জনের যাবজ্জীবন হওয়ার পরে কামদুনির ঘটনা যে বিরলতম অপরাধের মধ্যে পড়ে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। রাজ্যবাসীর বড় অংশই মনে করছেন, এই রায় প্রতিবাদীদের জয়। ভোটের মুখে সরকার তাই কামদুনি নিয়ে আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না বলেই প্রশাসনের অন্দরের খবর।

বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটের আগে আস্থা ফেরানোর চেষ্টাতেই এত দিনে নড়ে বসছে সরকার। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘প্রতিবাদীদের ভয় দেখাতে গিয়ে মানুষকে ভয় পেয়ে ভোটের আগে উন্নয়নের ঘোষণা করতে হচ্ছে!’’ প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান এবং বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘ভোটের মুখে উন্নয়ন করার জন্য জেলা প্রশাসনকে পাঠানোর উদ্দেশ্য মানুষ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। এলাকার মানুষ কী চাইছেন, মুখ্যমন্ত্রী তো সে কথা শুনতেই চাননি!’’

রাজ্য সরকার যদিও দাবি করছে, প্রশাসন কোনও ঘটনা বা কারও কথায় চালিত নয়। এ দিন জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘কারও কথা শুনে নয়, জেলা পরিষদ ও প্রশাসনের কর্তারা নিজেরাই কামদুনি যাবেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে আর কী কী প্রয়োজন তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।’’ কামদুনির তৃণমূল নেতা সনাতন (সোনা) মণ্ডল একটি তালিকা দেখিয়ে দাবি করছেন, ‘‘উন্নয়ন হয়নি, এ কথা সত্য নয়। আরও হবে। ক্লাবগুলো টাকা পেয়েছে।’’ ক্লাবে খয়রাতি তো এ রাজ্যে সর্বজনীন ব্যাপার। প্রকৃত উন্নয়নের কী হবে, সেটাই এলাকার মানুষের চিন্তা। তাঁদের বক্তব্য, সরকার তো প্রথম দফার প্রতিশ্রুতিই পূরণ করেনি। দ্বিতীয় দফায় কী হবে?

অন্য বিষয়গুলি:

kamduni
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE