গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের সময়ে ছিল মতুয়াদের নিয়ে টানাটানি। এ বার এ রাজ্যের ভোটে স্পষ্ট আর এক রকমের মেরুকরণ। এক দিকে বিজেপি-র উত্থান এবং তার পাশাপাশি ক্রমেই বাড়তে থাকা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা এই দুই বিপদের মোকাবিলায় সংখ্যালঘু ভোটই হয়ে উঠছে তৃণমূলের লাইফ লাইন। চার মাস আগের লোকসভা ভোট এবং সদ্য দুই বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে এমনই মনে করছে বিরোধীরা। এবং এই রসায়নে বিপদেরও গন্ধ পাচ্ছে তারা।
কলকাতার চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রে এ বার ১৪ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত দুই ওয়ার্ড ৪৪ ও ৬২ থেকেই ৭ হাজারের বেশি লিড পেয়েছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে যে ৬২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় সাড়ে চার হাজার ভোটে পিছিয়েছিল তৃণমূল, সেখানেই এ বার মোট প্রদত্ত ১৪ হাজার ভোটের মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি নিজেদের দিকে টানতে পেরেছে তারা! আবার বসিরহাট দক্ষিণে বিজেপি-র সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনার পিছনেও একই রসায়ন। লোকসভা ভোটে ওই বিধানসভা এলাকায় ৩২ হাজারেরও বেশি লিড ছিল বিজেপি-র। সেখানে গ্রামীণ এলাকা থেকেই যথাসম্ভব ভোট বাড়িয়েছে তৃণমূল। যার ফলে ব্যবধান কমে এসেছে বিজেপি-র সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত বসিরহাট ও টাকী পুরসভা এলাকা থেকে লিড নিয়ে আসনটি জিততে হয়েছে বিজেপি-কে। যে এলাকায় সংখ্যাগুরু হিন্দুরাই।
লোকসভা ভোটের পরে এই উপনির্বাচনে রাজ্যে আরও প্রান্তিক শক্তি হয়ে পড়েছে কংগ্রেস ও বামেরা। এই দু’দলেরই আশঙ্কা, ধর্মীয় ভাবাবেগের ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার প্রবণতা যদি এ রাজ্যে চেপে বসে, তা হলে তাদের পক্ষে পায়ের তলায় জমি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে! তাদের মতে, হিন্দুত্বের তাস বিজেপি বরাবরই খেলে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের দল যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায়, সেই সময়ে সংখ্যালঘুরা আরও বেশি করে অন্য দিকে ছাতা খুঁজছেন। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূলই তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারবে, এই ভাবনা থেকে সংখ্যালঘুরা শাসক দলের ঝুঁকছেন। আর এ সবের জেরে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে। বৃত্তের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে অন্যদের! ঠিক যেমন হয়েছে বসিরহাটে।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং তৃণমূলের ভোট-যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি মুকুল রায় নিজেই বুধবার বলেছেন, “বসিরহাটে বিজেপি-র ভোট কমেছে মাত্র ১%। কিন্তু ওখানে বাম ও কংগ্রেসের ভোট ভেঙে আমাদের দিকে চলে এসেছে।” দেখা যাচ্ছে, গত লোকসভা ভোটেও বসিরহাট দক্ষিণের গ্রামীণ এলাকায় বামেরা যা ভোট পেয়েছিল, তার অনেকটাই হারাতে হয়েছে এ বার। তুলনায় কম হলেও কংগ্রেসও ভোট হারিয়েছে। ঘটনাচক্রে, এই গ্রামীণ এলাকাতেই সংখ্যালঘু ভোট বেশি। এই এলাকা থেকে বেশি ফায়দা তুলেছে তৃণমূলই। যে কারণে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেছেন, “গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট বেশি বলে গণনার পাঁচ-ছয় রাউন্ড পর্যন্ত তৃণমূল এগিয়েছিল। শহরে হিন্দুদের ভোট বেশি। সেই ভোট বেশিটাই পড়েছে বিজেপি-তে। আমাদের বিপর্যয় হয়েছে। একে সাম্প্রদায়িক ভোট ছাড়া কী বলব!”
চৌরঙ্গির ৬২ নম্বর ওয়ার্ডেও ছবিটা একই। মোট ১৪ হাজারের কিছু বেশি ভোটের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থী নয়নাই পেয়েছেন ১০ হাজার ৪০টি ভোট! যে কংগ্রেস লোকসভায় এই ওয়ার্ডে সাড়ে চার হাজারে এগিয়েছিল, তারা পেয়েছে ৩৭২৪ ভোট। আর বিজেপি-র রীতেশ তিওয়ারির জুটেছে মাত্র ৫৬২টি ভোট! সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডেও ৪১৬০টি ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে আছেন নয়না। তৃণমূল বিধায়ক তথা ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইকবাল আহমেদ যতই এই ঘটনাকে ‘ইকবাল ম্যাজিক’ বলে বর্ণনা করুন, বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ সরাসরি বলছেন, “তৃণমূলই তো এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছে! উর্দুভাষী সংখ্যালঘুদের ভুল বুঝিয়ে তাদের ভোট আদায় করেছে তারা।” মুকুলবাবু বা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, বিজেপি-র মতো বিভাজনের রাজনীতি তাঁরা করেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেরুকরণের রাজনীতির মোকাবিলায় কী করবে বাকি দলগুলি? কারও কাছেই এর কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। বামফ্রন্টের এক সংখ্যালঘু নেতার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা যখন ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়া শুরু করলেন, তখন থেকেই আমাদের জোরালো প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তখন সাম্প্রদায়িক তাস খেলা হয়ে যাবে মনে করে আমরা পিছিয়ে এলাম। বিজেপি তার ফায়দা নিয়ে নিল!” বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য শাসক দলকেই দায়ী করে বলেছেন, “তৃণমূলই বাংলার রাজনীতিকে কলুষিত করেছে! তাদের জন্যই বিজেপি মাথা তুলছে!”
তবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম অবশ্য মনে করেন, এখনই হাল ছেড়ে দেওয়ার কিছু হয়নি। তাঁর বক্তব্য, “এই মেরুকরণ স্থায়ী প্রবণতা না-ও হতে পারে। বিজেপি এবং তৃণমূল নিজেদের স্বার্থে ভোটের মেরুকরণ ঘটিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি ডেকে আনছে, এটাই মানুষকে বোঝাতে হবে ভাল করে। আর নিরন্তর মানুষের লড়াইয়ে রাস্তায় থাকতে হবে।” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মতে, “বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপি-র মতো শক্তির মোকাবিলা জাতীয় স্তরে কংগ্রেস করতে পারে জেনেও সংখ্যালঘুরা কেন আমাদের উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না, ভেবে দেখতে হবে।” আবার ইউডিএফের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মতো কেউ কেউ মনে করছেন, তৃণমূল বেশি দিন সংখ্যালঘুদের ধরে রাখতে পারবে না। বরং বাম-কংগ্রেস নিস্তেজ হয়ে গেলে অন্যান্য সংখ্যালঘু সংগঠন বা মঞ্চও মাথা তুলতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy