Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

পুরনো মামলা খুঁড়ে ধৃত ন্যানো কমিটির দুই

ন্যানো প্রকল্প পাততাড়ি গুটিয়েছে ৭ বছর আগে। সিঙ্গুরে সেই ন্যানো কারখানার দাবিতে আন্দোলনকারীদের দু’জনকে হঠাৎ গ্রেফতার করল হুগলি জেলা পুলিশ! তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভাঙচুর-মারধরের। তামাদি হয়ে-যাওয়া একটি প্রকল্পের জন্য আন্দোলনের ভূত খুঁচিয়ে তুলে এই গ্রেফতার আসলে বিরোধী কণ্ঠ দমনেরই চেষ্টা কি না, ফের প্রশ্ন উঠে গেল এই পদক্ষেপে।

ধৃত দেবতনু মুখোপাধ্যায়

ধৃত দেবতনু মুখোপাধ্যায়

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপঙ্কর দে
সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

ন্যানো প্রকল্প পাততাড়ি গুটিয়েছে ৭ বছর আগে। সিঙ্গুরে সেই ন্যানো কারখানার দাবিতে আন্দোলনকারীদের দু’জনকে হঠাৎ গ্রেফতার করল হুগলি জেলা পুলিশ! তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভাঙচুর-মারধরের। তামাদি হয়ে-যাওয়া একটি প্রকল্পের জন্য আন্দোলনের ভূত খুঁচিয়ে তুলে এই গ্রেফতার আসলে বিরোধী কণ্ঠ দমনেরই চেষ্টা কি না, ফের প্রশ্ন উঠে গেল এই পদক্ষেপে।

সিঙ্গুর থানার পুলিশ শনিবার রাতে গ্রেফতার করেছে মৃন্ময় মাল এবং দেবতনু মুখোপাধ্যায়কে। ধৃত দু’জন ৭ বছর আগে তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের কর্মী ছিলেন। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের ন্যানো-বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সেই সময় ন্যানো-বাঁচাও কমিটি গড়ে পাল্টা আন্দোলন শুরু করেছিলেন কারখানার জন্য জমি দিতে ইচ্ছুক চাষিদের একাংশ। মৃন্ময় ও দেবতনুও সক্রিয় ভাবে সেই আন্দোলনে সামিল হয়ে সিঙ্গুরের পথে মিছিল-মিটিং করেছেন। সিঙ্গুরের জল এত দিনে গড়িয়েছে বহু দূর। তৃণমূলের আন্দোলনের জেরে সিঙ্গুরের কারখানা গুজরাতের সানন্দে তুলে নিয়ে গিয়েছেন রতন টাটা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা সিঙ্গুরের জমি ফেরতের ঘোষণা করলেও সেই সিদ্ধান্ত এখনও আইনি জটে আটকে। দেবতনু ও মৃন্ময়ও ইদানীং সিপিএম ছেড়ে বিজেপি-র দিকে ঘেঁষেছেন। সেই ‘অপরাধে’ই এত দিন পরে তাঁদের গ্রেফতার করানো হয়েছে বলে বিজেপি-সহ বিরোধীদের অভিযোগ।

ন্যানো বাঁচাও আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা উদয়ন দাসের অভিযোগ, মৃন্ময় ও দেবতনু সিঙ্গুরে কারখানার দাবিতে রাস্তায় নেমে ছিলেন। তাই পুলিশ ওঁদের জেলে ভরেছে। যদিও পুলিশের দাবি, ভাঙচুর-মারধরের অভিযোগ ছিল ধৃতদের বিরুদ্ধে। তাঁদের নামে মোট চারটে মামলা ছিল। ন্যানো-বাঁচাও কমিটির নেতারা আবার পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, হঠাৎ ৭ বছর বাদে সেই অভিযোগে গ্রেফতারের কথা মনে হল কেন? আন্দোলন-পর্বে সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা বেচারাম মান্না-সহ অনেক তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামেই বহু মামলা হয়েছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বহু মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। তা হলে মৃন্ময় ও দেবতনু বিরোধী দল করেন বলেই কি অন্যথা হল?

এ প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় পুলিশের মুখে কুলুপ। মন্তব্য করতে চাননি জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠীও। তবে তৃণমূলের দিকে না থাকার মাসুল যে দু’জনকে দিতে হয়েছে, প্রায় সেই ইঙ্গিতই মিলেছে মন্ত্রী বেচারামবাবুর মন্তব্যে। তিনি রবিবার বলেন,“ওই দু’জন সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনে ছিলেন না। বরং চাষিদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন! পুলিশ কেন ওঁদের গ্রেফতার করেছে, তা পুলিশই বলতে পারবে।”

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বুঝতে পারছেন, জমি ফেরতের ঘোষণা এখনও বিশ বাঁও জলে থাকায় সিঙ্গুরের মানুষের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। সিঙ্গুরে রাজ্য সরকারের দেওয়া দু’মাসের চাল এবং ভাতাও সম্প্রতি বকেয়া হয়েছিল। অতীতে জমি রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত এক ‘অনিচ্ছুক’ চাষি এ দিনই বলেছেন, “কারখানা হল না। জমিও ফেরত পেলাম না। এখন মনে হয়, জমি না দিয়ে খুব ভুল করেছি! কারখানাটা হলে অন্তত কিছু মানুষের রুটির ব্যবস্থা হত।” সিঙ্গুরে বিক্ষুব্ধ স্বর ক্রমশ জোরালো হচ্ছে বুঝেই বিধানসভা ভোটের আগে বিপদ আঁচ করে পুলিশ-প্রশাসনকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “সিঙ্গুরে কারখানার দাবিতে আন্দোলনের রূপরেখা যখন তৈরি করছি, তখনই আমাদের দুই কর্মীকে ধরল পুলিশ। কিন্তু সিঙ্গুরে চাষিকে শূন্য হাতে ঠকিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে, এ বাস্তব এখন সবাই বুঝতে পারছেন!” হুগলির বিজেপি নেতা স্বপন পালের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হতে দেব না! আমরাও দেখব, এ ভাবে আন্দোলনের অভিমুখ বন্ধ করে দিতে উনি সফল হন কি না!’’ মৃন্ময় ও দেবতনুর গ্রেফতারি ভাল চোখে দেখছেন না ন্যানো-বিরোধী আন্দোলনে থাকা অনিচ্ছুক চাষিদের একাংশও। তাঁদের এক জনের কথায়, “দু’হাজার টাকা আর দু’টাকার সরকারি চালে কত দিন সংসার বইব? আমরা কিন্তু আর মুখ বুজে থাকব না। গ্রেফতার হলেও না!’’

সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “রাজ্যে মাত্‌স্যন্যায় চলছে। এখানে শিল্পের কথা বলা যাবে না। বিরুদ্ধ রাজনৈতিক স্বরকে খুন করতে হবে যেন তেন প্রকারে!” কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়েই তৃণমূলকে জবাব দিতে হবে, জমি ফেরতের কী হল!’’ আর হুগলিরই বাসিন্দা, কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, ‘‘এটা শুধু সিঙ্গুর নয়, সর্বত্রই হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী এখন দেবী দুর্গার ভূমিকায় খড়্গহস্ত হয়েছেন। কিন্তু অসুরকে বাঁচিয়ে রেখে প্রতিবাদীদের বধ করছেন!’’ যা শুনে তৃণমূলেরই এক শীর্ষ নেতার প্রশ্ন, ‘‘হঠাৎ পুরনো ভূত ফিরিয়ে বিরোধীদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার কি দরকার ছিল?’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE