Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
TMC

পাল থেকে মণ্ডল, বার বার ‘তাপস-গেরো’য় রাজ্যের শাসক শিবির, এ কি নিছকই সমাপতন?

তাপস পাল দিয়ে শুরু। দলকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন তিনি। সম্প্রতি এখন রায় এবং চট্টোপাধ্যায় তাপসকে নিয়েও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে দলের অন্দরে। কিন্তু তৃতীয় তাপসও বেশ বেগ দিচ্ছেন।

এই সমাপতন জনিত ‘তাপস-গেরো’ নিয়ে কী ভাবছে শাসক তৃণমূল?

এই সমাপতন জনিত ‘তাপস-গেরো’ নিয়ে কী ভাবছে শাসক তৃণমূল?

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২২ ১২:০৪
Share: Save:

তিনি কি আদালতে গিয়ে হলফনামা দিয়ে নিজের নামটা বদলে নেবেন? দিনকাল যা পড়েছে! প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্ন শুনে ফোনে কিছু ক্ষণ অট্টহাস্য করলেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবীণ রাজনীতিক আপাতত রানিগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক। তার পর বললেন, ‘‘নাম এক হলেই তো আর সব কিছু এক হয় না!’’

শুরু হয়েছিল ‘পাল’ তাপসকে দিয়ে। সে অবশ্য অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু ইদানীং পর পর তাপস-গেরোয় আটকে যাচ্ছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল। কাকতালীয়? সমাপতন? হবেও বা। কিন্তু আশ্চর্য সমাপতন বৈকি!

তাঁর মতোই এখন খানিকটা জনতার বিস্মৃতিতে ‘দাদার কীর্তি’। কিন্তু শাসক তৃণমূলের ছোট-বড় সকলেরই মনে আছে অকালপ্রয়াত তাপস পালের মন্তব্য। আলিপুরের দু’বারের বিধায়ক, কৃষ্ণনগর থেকে দু’বারের সাংসদ দলকে অনেক সম্মান এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন ‘বেলাগাম’ হুমকিতে। নদিয়ার নাকাশিপাড়ার প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, ‘‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব!’’ চারদিকে ঢি-ঢি! বিরোধিরা রে-রে করে উঠেছিল। সমাজে ছিছিক্কার। দলের তরফে দূরত্ব রচনা। রাজনীতিতে এবং সামাজিক স্তবে কার্যত ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিভাধর অভিনেতা। তার পরে রোজভ্যালি-কাণ্ডে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তাতেও দলের অস্বস্তি বেড়েছিল। কারামুক্ত হয়ে ‘হুমকি’ নিয়ে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন্তব্য তাঁকে আমৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে। যেমন থেকেছে তৃণমূলের অস্বস্তি হয়ে।

কিন্তু সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে পর পর ‘তাপস’ দলের ‘অস্বস্তি’ বাড়াচ্ছেন, তাতে অন্যান্য ‘তাপস’-দের নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ তৈরি হয়েছে। প্রথম, দলের মুখপাত্র তথা বরাহনগরের বিধায়ক তাপস রায়। দ্বিতীয়, রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়। তৃতীয়, তাপস মণ্ডল। তিন নম্বর তাপস সরাসরি শাসক দলের ‘কেউকেটা’ নন। কিন্তু তা-ও তৃণমূলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম। কারণ, নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর হাতে ধৃত তৃণমূলের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত তিনি। যাঁকে ইতিমধ্যেই তলব করেছে ইডি। সে দিকেও সতর্ক নজর রাখছে শাসকদল।

‘রায়’ তাপস দলের প্রবীণ সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার তোপ দাগছেন। প্রথমে নীরব থাকলেও পাল্টা উত্তর দিয়েছেন সুদীপও। তার পাল্টা ফের তাপস। সব মিলিয়ে তাপস বনাম সুদীপ লড়াই খেয়োখেয়ির পর্যায়ে নেমে গিয়েছে। বস্তুত, সাম্প্রতিক কালে এতটা প্রকাশ্যে দলের দুই নেতার কোন্দল দেখা যায়নি। বিজেপি নেতা (প্রাক্তন তৃণমূল) তমোঘ্ন ঘোষের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময়ে সুদীপ কেন গিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাপস। বিজেপির সঙ্গে ‘প্রত্যক্ষ যোগাযোগ’ রেখে চলারও অভিযোগ তোলেন। যার পাল্টা সুদীপ বলে বসেন, ‘‘হাতি চলে বাজার, কুত্তা ভোঁকে হাজার।’’ যার জবাবে তাপস বলেন, ‘‘আমরা দলের ডোবারম্যান, আমরা দলের নিছকই গ্রে হাউন্ড, গ্রেট ডেন। সতর্ক করি, শত্রু দেখলে তেড়ে যাই। কিন্তু আমরা সাদা হাতি নই, অনুৎপাদক নই। আমরা নরেন্দ্র মোদীজি, অমিত শাহজি, ওম বিড়লার কাছে গিয়ে শুঁড় নাচিয়ে বন্দনা, ভজনা করি না।’’

এই প্রকাশ্য লড়াই থামাতে তৃণমূল যে সামান্য চেষ্টা করেনি, তা নয়। কিন্তু ঘটনা থামেনি। যদিও দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দেন, তিনি সুদীপের পাশেই আছেন। বিতর্ক চলার মধ্যেই সুদীপকে সস্ত্রীক দেখা গিয়েছিল মমতার পাশে। তার পরেও তাপস-তোপ থামেনি। যদিও ইদানীং দু’পক্ষই নীরব। মনে করা হচ্ছে, বিদেশ থেকে চোখের চিকিৎসা করিয়ে দলের অন্যতম শীর্ষনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শহরে ফিরলে সেই বাক্স আবার খোলা হবে।

তবে এর মধ্যেই ‘রায়’ তাপসের মতো দলের অস্বস্তি তৈরি করে ফেলেছেন ‘চট্টোপাধ্যায়’ তাপস। সেটি আবার স্বয়ং মমতার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই। তাঁরই বিধানসভা এলাকার ইকো পার্কে গত ১২ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী বিজয়া সম্মিলনীতে যোগ দেন। সেখানে তিনি কেন আমন্ত্রণ পাননি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরের দিন তাপস প্রকাশ্যেই বলেন, ‘‘এটা শুধু আমার নয়, নিউটাউনবাসীরও অপমান!’’ সিপিএম থেকে তৃণমূলে-আসা নেতা তাপস সে দিন আরও বলেছিলেন, ‘‘আমি অনুষ্ঠান সম্পর্কে কিছু জানি না। আমি নিজে আমন্ত্রিতও ছিলাম না। এটা গত বছরেও হয়েছিল। তখন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখনও কোনও সদর্থক উত্তর পাইনি।’’ সেখানেই থামেননি এলাকায় ‘জিম্বো’ বলে পরিচিত বিধায়ক। তিনি শ্লেষাত্মক ঢঙে বলেছিলেন, ‘‘আমার কাজ বা স্ট্যাটাস বোধহয় এই ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়ার উপযুক্ত নয়। দলে বাবু ও চাকরের মধ্যে আমরা বোধহয় সেকেন্ডটার (দ্বিতীয়) মধ্যে পড়ি।’’ কারও নাম না-করলেও এই তাপসের লক্ষ্য যে ছিলেন বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র তথা বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরে-আসা সব্যসাচী দত্ত, তা তৃণমূলের অন্দরে সকলেই জানতেন। ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন সব্যসাচী।

ইদানীং পর পর তাপস-গেরোয় আটকে যাচ্ছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল।

ইদানীং পর পর তাপস-গেরোয় আটকে যাচ্ছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল।

তৃতীয় তাপস ‘মণ্ডল’। নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর বড় ভূমিকা রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইতিমধ্যে তাঁকে তলবও করেছে ইডি। তাঁর ‘টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার’ এবং বাড়িতেও হানা দিয়েছে ইডি। তাপসের সংস্থা ‘মিনার্ভা টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার’-এর মাধ্যমে টাকা লেনদেনের তথ্যও সামনে আসছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। ‘মিনার্ভা ফিনান্স’ নামে চিটফান্ড খুলে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন বলে অভিযোগ। সেই তাপস সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, রাজ্যের ৫৩০টি বেসরকারি বিএড এবং ডিএলএড কলেজের থেকে মানিকের ছেলে শৌভিক ভট্টাচার্যের সংস্থা এককালীন ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছিল। তাপস নিজের তিনটি কলেজের জন্য মোট দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেন। সেই সঙ্গে বিভাস অধিকারী নামে এক তৃণমূল নেতার নাম করেন। বলেন, ‘‘সব কলেজ টাকা দিয়েছিল। টাকা দিতে বলা হয়েছিল। তাই আমরাও দিয়েছি। বিভাস আমাদের বলেছিল, স্যরের নির্দেশ মতো টাকা দিতে হবে।’’ প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার তাঁকে ইডির কাছে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। তাপসের পুত্র জানিয়েছেন, তাঁর বাবা হাজিরা দেবেন। যদিও বুধবার পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও ‘পাকা খবর’ মেলেনি।

এই সমাপতন জনিত ‘তাপস-গেরো’ নিয়ে কী করছে শাসক তৃণমূল? প্রত্যাশিত ভাবেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না। ‘রায়’ এবং ‘চট্টোপাধ্যায়’ তাপসকে নিয়ে সমস্যাকে ‘বাসনের ঠোকাঠুকি’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন দলের মুখপাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘তিন তাপসকে এক সারিতে রাখা ঠিক হবে না। তাপস রায় এবং তাপস চট্টোপাধ্যায় দলের সম্পদ। ওঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্বে সব সময় ভরসা রাখেন। যেটা হয়েছে, সেটা যে কোনও একান্নবর্তী পরিবারে হয়। রান্নাঘরে বাসন থাকলে ঠোকাঠুকি লাগেই। আর তাপস মণ্ডল নিয়ে যা চলছে, সে দিকে দল সর্বদা নজর রাখছে।’’

ফেরা যাক ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাপসে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় তাঁর পুরনো কেন্দ্র আসানসোল-দক্ষিণ সায়নী ঘোষকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাঁকে। দলনেত্রী মমতার সিদ্ধান্ত জানার পর নীরবে চলে গিয়েছিলেন রানিগঞ্জে। সেখান থেকেও জিতেছেন। আর বলছেন, ‘‘তাপস নামের অর্থ ‘তপস্বী’। আমি নিজের নামের অর্থ মাথায় রেখেই কাজ করি। অন্য কারও সঙ্গে তাই তুলনা চলবে না। আমার নাম নিয়েই আমি মাথা উঁচু করে বিতর্ক এড়িয়ে থাকতে জানি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

TMC tapas pal Tapas Mandal Tapas Chatterjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy