Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

দাদাগিরির দায়ে ঘোলাতেও ছাড় পেলেন তৃণমূল নেতারা

সিভিক ভলান্টিয়ারদের পেটানোর দায়ে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। এক জনকে গ্রেফতার করে চার দিনের জন্য হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু এক দিন পরে পুলিশই আদালতে জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব সারা হয়ে গিয়েছে। ফলে পত্রপাঠ জামিন পেলেন ওই অভিযুক্ত। দ্বিতীয় জনের নাম ছিল অভিযুক্তের তালিকার শীর্ষে। তাঁকে গ্রেফতার তো করা হয়ইনি, উপরন্তু খোদ পুলিশ কমিশনার কার্যত যুক্তি দিয়েছেন যে, ওই ব্যক্তি ঘটনাস্থলে ছিলেন না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১৪
Share: Save:

সিভিক ভলান্টিয়ারদের পেটানোর দায়ে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। এক জনকে গ্রেফতার করে চার দিনের জন্য হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু এক দিন পরে পুলিশই আদালতে জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব সারা হয়ে গিয়েছে। ফলে পত্রপাঠ জামিন পেলেন ওই অভিযুক্ত। দ্বিতীয় জনের নাম ছিল অভিযুক্তের তালিকার শীর্ষে। তাঁকে গ্রেফতার তো করা হয়ইনি, উপরন্তু খোদ পুলিশ কমিশনার কার্যত যুক্তি দিয়েছেন যে, ওই ব্যক্তি ঘটনাস্থলে ছিলেন না।

প্রথম জন তৃণমূলের ছাত্র নেতা অশোক মল্লিক। দ্বিতীয় জন এলাকার নাগরিক কমিটির সম্পাদক তথা তৃণমূলের পূর্ব পানিহাটির সভাপতি সম্রাট চক্রবর্তী। রাজনৈতিক বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দলের উপরমহলের চাপেই প্রথমে কড়া পদক্ষেপ সত্ত্বেও পরের দিকে এমন ঢিলেঢালা মনোভাব নিয়েছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় নৈশপ্রহরীদের সঙ্গে অশোক ও তাঁর সঙ্গীদের ঝামেলা বাধে। এক জন নৈশপ্রহরী সম্রাটকে বাড়ি থেকে ডাকতে যান। সেই সময়ে এসে পড়ে ঘোলা থানার রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড। গাড়ি থেকে দুই সিভিক ভলান্টিয়ার নামতেই তাঁদের হেনস্থা করা হয়। অভিযোগ, সম্রাটও সেই সময়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন। পরে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিগ্রহের দায়ে অশোককে গ্রেফতার করা হয়। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ তখন বলেছিলেন, ‘‘ঘটনার পরে সম্রাট ওখানে গিয়েছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি। খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ কিন্তু সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি পুলিশ।

জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব গোড়া থেকেই দাবি করে আসছিলেন, গণ্ডগোলের সময়ে সম্রাট সেখানে ছিলেন না। এ দিনও তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ দাবি করেছেন, ‘‘গোলমালের খবর পেয়েই সম্রাট তা মেটাতে সেখানে গিয়েছিলেন।’’ সম্রাটের নিজেরও তা-ই দাবি। অশোককে শনিবার ব্যারাকপুর আদালতে তুলে চার দিনের জন্য হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সোমবারই জানানো হয়, জেরা হয়ে গিয়েছে। জামিন পেয়ে যান ওই ছাত্র নেতা। এ নিয়ে বুধবার পুলিশ কমিশনারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা ঘটনার সময় ছিলেন, তাঁদের তো গ্রেফতার করে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু জামিনের বিষয়টা তো আদালতের। পুলিশের কী করার থাকতে পারে?’’ বিরোধীদের অভিযোগ, এই কথা বলে পুলিশ কমিশনার কার্যত তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্যেই সিলমোহর দিলেন যে, ঘটনার সময়ে সম্রাট সেখানে ছিলেন না। পুলিশ কি তা হলে ওই জামিনের নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে? কমিশনারের কাছ থেকে এই প্রশ্নের ইতিবাচক কোনও জবাব মেলেনি।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের একটি থানার এক ইন্সপেক্টর বলেন, ‘‘দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতা নির্মলবাবু যে দাবি করেছিলেন, সেটিকেই আমাদের উপরতলা মেনে নিচ্ছে। তা হলে তো বলতে হয়, শুক্রবার রাতে ঘোলা থানার যে অফিসার সম্রাটবাবু ও অশোকবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, তিনি মিথ্যে কথা লিখেছিলেন।’’ সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে এ দিন আনন্দবাজারের তরফে যোগাযোগের চেষ্টা হয়। কিন্তু তাঁর মোবাইল রাত পর্যন্ত বন্ধ ছিল।

পুলিশের নিচুতলার বক্তব্য, ঠিক ভাবে মামলা সাজালে কখনওই সরকারি কর্মীকে কাজে বাধা ও নিগ্রহের দায়ে অভিযুক্ত জামিন পেতে পারে না। এ রাজ্যে রাজনৈতিক নেতা বা তাঁদের ঘনিষ্ঠদের হাতে পুলিশকর্মীদের মার খাওয়ার ঘটনা আর নতুন কিছু নয়। আলিপুর থানায় হামলার সময়ে ফাইলের আড়ালে পুলিশের মুখ লুকোনো থেকে শুরু করে লেকটাউনে শাসক দলের সাংসদের হাতে ট্রাফিক কনস্টেবলের নিগৃহীত হওয়া— প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা গিয়েছে, মূল অভিযুক্তরা অধরা। বড়জোর জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশই আদালত থেকে জামিন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কোথাও চার্জশিট এমন ভাবে লেখা হয়েছে যাতে মনে হয়, নিগৃহীত পুলিশকর্মীই অসত্য বলছেন।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের আর এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘কিছুদিন আগে খড়দহে লুমটেক্সের সামনে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশকর্মীদের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তারও কিছুদিন আগে এই ঘোলাতেই মদ্যপদের হাতে মার খেয়েছিলেন এক পুলিশ অফিসার। দু’টি ঘটনাতেই জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছিল, কিন্তু জামিনও হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি। কারণ মামলার পর সেটি নিয়ে পুলিশই খুব বেশি এগোয়নি।’’ কাজেই ঘোলার সাম্প্রতিক ঘটনায় যে ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে, এমন আশা তাঁরা করেননি বলে জানাচ্ছেন ওই অফিসার। অধস্তন এক পুলিশকর্মী আরও ক্ষুব্ধ। বললেন, ‘‘আমরা শুনেছি অশোকের জামিনের সময়ে সরকারি আইনজীবীই আদালতে হাজির ছিলেন না।’’

গোটা ঘটনায় সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি একযোগে আক্রমণ শানিয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! দিদির ভাইয়েরাই এখন পুলিশকে শাসন করছেন। আর পুলিশ অপমানিত হলেই পুলিশমন্ত্রী আনন্দ পাচ্ছেন!’’ বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের তির্যক মন্তব্য, ‘‘ঘোলায় অভিযুক্তকে নিয়ে পুলিশ যা করেছে, ঠিক কাজ করেছে। প্রথমে চার দিনের হেফাজতে নিয়েই পুলিশ ভুল করেছিল। যুগধর্ম মেনে দ্রুত সেই ভুল শুধরে নেওয়া হয়েছে!’’ কংগ্রেসের বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও অভিযোগ, পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারতী ঘোষের মতো ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুগত’ পুলিশ সুপারের দাপট বাদ দিলে সব জেলাতেই পুলিশের আর কোনও ভূমিকা নেই! তাঁর কথায়, ‘‘ঘোলায় যা হয়েছে, তার পরে পুলিশ কমিশনার এবং ডিজির আর উর্দি পরে থাকার দরকার নেই। তাঁদের উচিত পুলিশকে তৃণমূলের ঝান্ডাধারী বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE