গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
‘সন্দেশখালি মডেল’ই কি পথ? ভবিষ্যতেও কি এমনই হবে? নাকি সন্দেশখালি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে ‘সহযোগিতা’র পথে হাঁটা হবে? শুক্রবার সকালে সন্দেশখালির ঘটনার পরে বিবিধ জল্পনা শুরু হয়েছে শাসক তৃণমূলে।
সন্দেশখালির ঘটনার অব্যবহিত পরে শাসকদলের কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ মহলে উল্লাসই দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বেলা বাড়তে তৃণমূলের মধ্যেও উদ্বেগের চোরাস্রোত বইতে শুরু করে। যাতে ‘অনুঘটক’-এর ভূমিকা পালন করে বিজেপির প্রচার। ফলে শাসকদলের নেতাদের কথায় সন্দেশখালি নিয়ে মতের বৈপরীত্য স্পষ্ট। কেউ কেউ ঘরোয়া আলোচনায় সন্দেশখালি নিয়ে তাঁদের দোদুল্যমানতার কথাও মেনে নিচ্ছেন।
সন্দেশখালির ঘটনাকে তৃণমূলের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় এজেন্সির ‘আগ্রাসী’ মনোভাবের বিরুদ্ধে পাল্টা আগ্রাসনের মডেল হিসেবে দেখাতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, স্থানীয় স্তরে এই ধরনের ‘প্রতিরোধ’ হলে কেন্দ্রীয় সংস্থাও ভবিষ্যতে সমঝে চলবে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। সেই সঙ্গে শাসকদলের মধ্যে এমনও আলোচনা রয়েছে যে, সর্বত্র এই মডেল বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। এর আগে অনেক তল্লাশি হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু কোথাও এই দৃশ্য দেখা যায়নি। শুক্রবারেও বনগাঁ, গাইঘাটা-সহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছে ইডি। সেখানে কিন্তু সন্দেশখালির মতো ঘটনা ঘটেনি।
সন্দেশখালিতে কী হল? তৃণমূলের এক মন্ত্রী ঘরোয়া আলোচনায় স্থানীয় স্তরে শাহজাহান শেখের দাপটকেই ‘কৃতিত্ব’ দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, যে ভাবে মহিলারা বিক্ষোভ দেখাতে বেরিয়ে এসেছিলেন, জায়গায় জায়গায় গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ শুরু হয়েছিল, তা নিচুতলায় মজবুত সংগঠন না থাকলে হয় না। কিন্তু রাজ্যের সর্বত্র সন্দেশখালির মতো জনবিন্যাস নেই। সে সব জায়গায় কী হবে? তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে তৃণমূলের মধ্যে। শাসকদলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘সন্দেশখালিকে মডেল ভাবা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা হবে না। কারণ, এই জিনিস সংক্রমিত হলে অন্য বিপদ হবে।’’
সেই নেতা যে প্রেক্ষাপটে ‘বিপদের’ কথা বলেছিলেন, বেলা গড়াতে তা বিজেপির প্রচারে স্পষ্ট হয়ে যায়। ‘চেনা সিলেবাসে’ প্রচারে নেমে পড়ে গেরুয়া শিবির। অমিত মালব্য থেকে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরা অনুপ্রবেশ, রোহিঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেন। তৃণমূলের আশঙ্কা, এর ফলে লোকসভা ভোটের আগে মেরুকরণকে আরও তীব্র করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বিজেপি। যে মেরুকরণ বসিরহাট আসনের জন্যও খুব একটা শুভ সঙ্কেত নয়। প্রকাশ্যে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সন্দেশখালির ঘটনাকে দু’টি শব্দে অভিহিত করেছেন— ‘উদ্বেগজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক’। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ‘উস্কানি’কেও দায়ী করেছেন কুণাল। প্রশ্ন তুলেছেন, কেন পুলিশকে না জানিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবে ইডি? অনেকের মতে, কুণালের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তৃণমূলের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। তৃণমূলের এক তরুণ নেতার বক্তব্য, এই ঘটনার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে পারে। সেই অভিঘাত যে শুধু বসিরহাটে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা-ও নয়। ফলে স্থানীয় স্তরে প্রতিরোধ ‘ইতিবাচক’ হলেও অন্যত্র তার প্রভাব ‘নেতিবাচক’ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
২০১৩ সালে শাহজাহান তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকে বসিরহাট সন্দেশখালিতে তাঁর দাপট ক্রমে বাড়তে থাকে। এক কালে বাম বিধায়ক অবনী রায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন শাহজাহান। সরবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধান তথা এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতা মোসলেম শেখেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন শাহজাহান। ভেড়ির কাঁচা টাকাই শাহজাহানের উত্থানের নেপথ্যে বলে স্থানীয় মানুষজন মনে করেন। কিন্তু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকে শাহজানের উত্থান হতে থাকে উল্কার গতিতে। প্রসঙ্গত, উত্তর ২৪ পরগনা তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, শাহজাহানকে তৃণমূলে ‘আশ্রয়’ দেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন অধুনা জেলবন্দি মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তবে বিজেপির দাবি, তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বেরও ‘ঘনিষ্ঠ’ শাহজাহান।
সীমান্ত লাগোয়া এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই সরব। গেরুয়া শিবিরের এ-ও দাবি, বাংলাদেশ থেকে লোক ঢুকিয়ে এলাকার জনবিন্যাস বদলে দেওয়া হচ্ছে। সন্দেশখালির ঘটনার পর বিজেপি সেটাকেই আরও ‘প্রামাণ্য’ করে ফেলতে পারল বলে মনে করছেন অনেকে। যা শাসকদলের জন্য খুব ‘স্বস্তিজনক’ নয়। এ কথা ঠিক যে, আগে ইডি থাকলেও তাদের ভূমিকা নিয়ে এত আলোচনা হত না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের সময়ে এই সংস্থাটির ভূমিকা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। ফলে সন্দেশখালি নিয়ে নয়াদিল্লির ‘প্রতিক্রিয়া’ হওয়াও অমূলক নয়। ফলে শাসকদলের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, কাজটা খানিক ‘হঠকারী’ হয়ে গিয়েছে। এর জল কত দূর গড়ায়, এখন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy