অঘোর হেমব্রম। নিজস্ব চিত্র
পঞ্চায়েত ভোটে বলরামপুরে তৃণমূলের ভরাডুবির সঙ্গেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দলের এলাকার মুখ হয়ে ওঠা সপুত্র সৃষ্টিধর মাহাতো। তাঁদের পায়ের তলা থেকে সরে যাওয়া মাটি কেড়ে নিয়েছে বিজেপি। তারই মধ্যে বলরামপুরে দলের তিন কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাকে বড় আন্দোলনের চেহারা দিয়ে ভিত শক্ত করতে নেমে পড়েছে গেরুয়া শিবির। এই ‘কঠিন’ সময়ে শাসকদলের কাছে ফের বলরামপুরের ভরসা হয়ে উঠেছেন অঘোর হেমব্রম। তাঁকে তৃণমূলের বলরামপুর ব্লকের আহ্বায়ক করা হয়েছে।
মাওবাদী জমানার শেষ লগ্নে যে ভাবে অঘোরকে সঙ্গে করে বলরামপুর নিজেদের দখলে এনেছিল তৃণমূল, এ বারও সে পথেই তারা চলতে চায় বলে মনে করছেন জেলার রাজনীতি সচেতন মানুষজন। বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, ‘‘অঘোরের অতীত সবাই জানেন। নিজের বাহিনী নিয়ে বলরামপুরে আগে তিনি কেমন দাপট দেখিয়েছেন, মানুষ তা ভোলেননি। সেই ইমেজ কাজে লাগিয়েই তিনি তৃণমূলকে এনেছিলেন। শাসকদল যদি মনে করে, অঘোরের সেই কৌশলেই বলরামপুর তারা পুনরুদ্ধার করবে, তা ভুল। কারণ বলরামপুর এখন শান্তি চায়। তাই আমাদেরই ভরসা করেছেন।’’ যদিও অঘোরের পাল্টা দাবি, ‘‘বিজেপি অপপ্রচার করে ক্ষমতায় এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে মানুষের উন্নয়ন করেছেন, তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা বোঝাব। ফের বলরামপুর তৃণমূলেরই হবে।’’
সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল ভাল ফল করলেও গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে বলরাপুরের পরাজয়। অযোধ্যা পাহাড়ের গাঁগুলোয় কী ভাবে রাতারাতি প্রভাব বিস্তার করে বিজেপি সাতটি পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদের দু’টি আসনই কেড়ে নিল, তা ভেবে তাজ্জব অনেক তৃণমূল নেতাই। দলের ময়নাতদন্তে উঠে আসে, বলরামপুরের নেতা তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর আচরণে অনেকেই তৃণমূলের উপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। দলের জেলা পর্যবেক্ষক যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় ফল পর্যালোচনা করতে এসে বলরামপুরের ব্লক সভাপতির পদ সৃষ্টিধরের ছেলে সুদীপকে সরানোর নির্দেশ দেন। কে ওই জায়গায় আসবে, তা নিয়ে জল্পনা চলছিল।
মঙ্গলবার তৃণমূলের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো অঘোরকে দলের বলরামপুর ব্লকের আহ্বায়ক করার কথা ঘোষণা করেন। রাজনীতির ময়দানে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার কর্মী হিসেবে অঘোরের আসা। অযোধ্যা পাহাড়তলির ঘাটবেড়া-কেরোয়া এলাকার নন্দুডি গ্রামের বাসিন্দা অঘোরের উত্থান ২০০৮ সালের শেষের দিকে, বলরামপুরে আদিবাসী মূলবাসী জনগণের কমিটির আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে।
এক সময়ে অঘোরকে মাওবাদীদের লিঙ্কম্যান অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতারও করেছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজ্যে পালাবদলের ঠিক আগে সঙ্গীদের নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন অঘোর। তাঁকে তৃণমূলে নিয়ে আসায় মূল ভূমিকা ছিল দলের তৎকালীন বলরামপুর ব্লক সভাপতি সৃষ্টিধরের। ধারাবাহিক ভাবে মাওবাদী নাশকতায় তখন উত্তাল বলরামপুর। কখনও স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কখনও স্টেশন ম্যানেজারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কখনও পুলিশের চর সন্দেহে রাজনৈতক নেতাকে গুলি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যৌথবাহিনী-মাওবাদীদের গুলিযুদ্ধ চলছে।
রাজ্যে পালাবদলের মধ্যে দিয়ে বলরামপুর তৃণমূলের দখলে এলেও সেখানকার অবস্থার বিশেষ বদল হয়নি তখনও। শাসক দলের ছায়ায় গড়ে ওঠে জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি। সেই কমিটির মুখ হিসেবে নতুন ভূমিকায় উত্থান অঘোরের। মাওবাদীদের মূল স্ত্রোতে ফেরানোর ডাক দেয় সেই কমিটি। গ্রামে গ্রামে মোটরবাইক মিছিল করে যুব সম্প্রদায়কে বিপথগামী না হয়ে এলাকার উন্নয়নে সামিল হতে বোঝানোর কাজ শুরু করে তারা। অঘোরের সঙ্গে ছিলেন সৃষ্টিধর। ফলও মেলে। ২০১৩ সালে বলরামপুরের সাতটি পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদের আসনে জিতে আসে তৃণমূল।
সৃষ্টিধর হন জেলা সভাধিপতি। তাঁর ছেলে বলরামপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি। দল সূত্রের খবর, এরপরেই কার্যত আড়ালে চলে যান অঘোর। সময় যত গড়িয়েছে, দলের বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে সরে গিয়েছেন তিনি। বাসিন্দাদের দাবি, ততই সপুত্র সৃষ্টিধরের দাপট বাড়তে থাকে। যদিও সৃষ্টিধর বারবার ‘দাপট’ দেখানোর অভিযোগ উড়িয়ে দিতেন।
কিন্তু, পাঁচ বছর পরেই ছবিটা বদলে গিয়েছে। ভোটে পরাজিত সৃষ্টিধর ও তাঁর ছেলে সুদীপের (তিনি অবশ্য জিতেছেন) সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দলীয় কর্মসূচিতেও তাঁদের এখন থাকতে বারণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন এক জেলা তৃণমূল নেতা। বরং পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে কয়েক সপ্তাহ আগে শিমুলিয়ায় সভা করতে এসে অঘোরের নাম করতে শোনা গিয়েছিল। শান্তিরাম বলেন, ‘‘অঘোরই আপাতত বলরামপুরে দলের দায়িত্ব সামলাবেন।’’
বুধবার সুদীপ বলেন, ‘‘অঘোরকাকা দলের সঙ্গেই ছিলেন। দল তাঁকে বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা তাঁকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফের বলরামপুরকে পুনরুদ্ধার করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy