কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।-ফাইল চিত্র।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের প্রশ্ন ছিল, সাংসদ-মন্ত্রীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করছেন কি না। প্রধান বিচারপতির প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, সওয়াল করতে উঠে তৃণমূলেরই সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির আদালতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘ঘুষ ও অনুদানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ওই ছবি তোলা হয়েছে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে।’’ তবে, কল্যাণবাবু এই কথা বললেও, কার্যত যে তাঁর দল কোণঠাসা তার প্রমাণ আদালতের কাছে এ দিন তাঁর আবেদনে। তিনি এ দিন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগে এমন কোনও নির্দেশ যেন আদালত না দেয়, যাতে বিরোধীরা তা হাতিয়ার করতে পারে। নির্বাচনের পরে রায় দিক আদালত।’’
গোপন ক্যামেরায় ঘুষ নেওয়ার বিতর্কের জেরে জনস্বার্থে দায়ের হওয়া মামলার শুনানিতে কল্যাণবাবুর এই সওয়াল শুনে আদালতের বাইরে আইনজীবীদের অনেককেই এ দিন বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘তা হলে তো টাকা নেওয়ার কথা পরোক্ষে স্বীকারই করে নেওয়া হল।’’
তা হলে কি পরোক্ষে তিনি স্বীকার করছেন টাকা নিয়েছিলেন তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদেরা? এ দিন ওই প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব দেননি কল্যাণবাবু। তিনি আদালতের বাইরে বলেন, ‘‘আদালতে কী বলেছি, তার ব্যাখ্যা আদালতের বাইরে সংবাদমাধ্যমের কাছে দেব না।’’ তবে একই সঙ্গে কল্যাণবাবুর দাবি, ‘‘এই মামলা ধোপে টিকবে না। কারণ, জনপ্রতিনিধি আইনে কোথাও প্রার্থীর অনুদান নিতে বাধা নেই। ভোটদাতাকে টাকা দিয়ে প্রলোভিত করলে তা অপরাধ।’’
গত ১৮ মার্চ প্রধান বিচারপতি জনস্বার্থে দায়ের হওয়া তিনটি মামলার আবেদনকারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, নারদ নিউজকে (যে সংস্থা দাবি করছে, গোপন ক্যামেরায় তোলা ঘুয নেওয়ার ভিডিও ফুটেজ তাদেরই) মামলার নোটিস ২১ মার্চের মধ্যে পাঠাতে। মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল এ দিন।
এ দিন বেলা ২টোয় মামলা তিনটি একত্রে শুনানির জন্য ওঠে। প্রধান বিচারপতি আদালতে জানতে চান, নারদ নিউজের পক্ষে কোন আইনজীবী দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল তথা হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী বিমল চট্টোপাধ্যায় জানান, তিনি ওই সংস্থার পক্ষে হাজির হয়েছেন। এর পরে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, ভারতের নির্বাচন কমিশনকে মামলার নোটিস পাঠানো হয়েছে কি না। সঠিক ভাবে ওই নোটিস পাঠানো হয়নি জেনে প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দেন, অবিলম্বে সঠিক ভাবে নোটিস পাঠাতে।
এর পরে প্রধান বিচারপতি মামলার অন্যতম আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে জানতে চান, তাঁর কী বলার রয়েছে। বিকাশবাবু জানান, ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের মন্ত্রী, দেশের সাংসদ ও শাসক দলের একাংশকে। এই ঘটনায় এক আইপিএস অফিসারের নামও জড়িয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ওই ভিডিও ফুটেজে কারচুপি রয়েছে। তাই সবার আগে জানা দরকার, ওই ভিডিও ফুটেজ যাচাই করা দরকার। জানা দরকার, ফুটেজ কতটা খাঁটি।
তা শুনে প্রধান বিচারপতি নারদা-র আইনজীবী বিমলবাবুর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি আদালতে হলফনামা দিয়ে বলুন, এই ফুটেজ ‘জেনুইন’ (খাঁটি) কি না। খাঁটি না হলে এই ফুটেজ আদালত গ্রহণই করবে না।’’
আইনজীবী বিমলবাবু বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত কিন্তু কেউই এই কথা বলেনি, এই ফুটেজ খাঁটি নয়। এটা খাঁটি কি না, তা চ্যালেঞ্জও করেনি কেউ। তবে আদালতের নির্দেশ মতো আমি হলফনামা দিয়ে জানাব, এটি খাঁটি কি না। আদালতকে আমি সন্তুষ্ট করব।’’
আরও পড়ুন- ভিডিওর জালে এ বার অপরূপা, সঙ্গে শঙ্কুদেবও
প্রধান বিচারপতি তা শুনে আইনজীবী কল্যাণবাবুর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি এই ফুটেজের সত্যতা স্বীকার করছেন কি?’’ কল্যাণবাবু বলেন, ‘‘একেবারেই করছি না।’’
ঘুষ-বিতর্কে নাম জড়ানো আইপিএস এসএম মির্জা-র আইনজীবী কিশোর দত্ত এর পরে বলেন, আদালতের জানা দরকার, যে সংস্থা দাবি করছে, গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও ফুটেজ তাদের, তা হলে সেই সংস্থার পরিচয় কি। সেই সংস্থা কারা চালায়। কে তাদের টাকা জোগায়। সেই টাকা কোথা থেকে জোগানো হয়েছে। সেই সংস্থার পূর্বের কাজকর্ম সম্পর্কেও আদালতের খোঁজ নেওয়া দরকার।
আইনজীবী কল্যাণবাবু এর পরেই বলেন, ‘‘এই ফুটেজে কারচুপি রয়েছে। এর সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। ঘুষ ও অনুদানের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা জানা দরকার। এই ফুটেজ ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে তোলা। ২০১৪ থেকে এত দিন ওই ফুটেজ প্রকাশ হল না কেন, কেনই বা বিধানসভা ভোটের মুখে প্রকাশ হল? এর অর্থ হল, পুরোপুরো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে। জনস্বার্থে করা হয়নি।
কল্যাণবাবুকে বাধা দিয়ে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই ফুটেজ খাঁটি কি না, তা বলুন।’’
বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে কল্যাণবাবু বলেন, ‘‘ওই ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিজেপি সাংবাদিক সম্মেলন করে ফুটেজের অংশ বিশেষ বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমগুলির কাছে পৌঁছে দেয়। আর, সংবাদমাধ্যগুলি সেই ফুটেজ তাদের চ্যানেলে চালানোর সময় বলতে থাকে, এই ফুটেজ তাদের তোলা নয়। তাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই।’’
তা শুনে প্রধান বিচারপতি মামলার আবেদনকারীদের আইনজীবীদের নির্দেশ দেন, তাঁদেরও হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, এই ফুটেজ খাঁটি জেনেই তারা জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেছেন।
এরপরে প্রধান বিচারপতি নারদা-র আইনজীবী বিমলবাবুকে নির্দেশ দেন, ‘‘নারদ লিমিটেড কোম্পানির অংশীদার কারা, তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে, তাদের শেয়ার হোল্ডার কে তা সব হলফনামায় জানাতে হবে। এও জানাতে হবে যে, কে, কখন, কবে ওই ভিডিও ফুটেজ তুলেছিলেন। যে যন্ত্রের সাহায্যে ফুটেজ তোলা হয়েছিল সেই যন্ত্র ও ফুটেজের বিস্তারিত আদালতে জমা দিতে হবে নারদা নিউজকে।’’ এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ৮ এপ্রিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy