অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
মাঝখানে পুণ্যসলিলা গঙ্গা। ও পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনের সদর দফতর ১৪ তলা নীলবাড়ি। এ পারে হেস্টিংস মোড়ের কাছে বঙ্গ বিজেপি-র ১০ তলা ‘ওয়ার রুম’। যে বাড়ির ছাদ থেকে নবান্ন দেখতে পাওয়া যায়। আসন্ন বিধানসভা ভোট আসলে বিজেপি-র কাছে পানি-পথের যুদ্ধ। এ পারের বহুতল থেকে গঙ্গা পেরিয়ে ও পারের বহুতলে যাওয়ার লড়াই। কাকতালীয় ভাবে, বিজেপি-র ‘ওয়ার হাউস’-এর গায়ে নীল-সাদা রঙের পোঁচ রয়েছে। যে নীল-সাদা মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রিয় রং বলেই পরিচিত। নীলের সঙ্গে সাদার ছোঁয়া রয়েছে ‘নীলবাড়ি’ নবান্নেও। সেই নীলবাড়ি দখলের লক্ষ্যে কেন্দ্র এবং রাজ্য বিজেপি যে বাড়িটি বেছে নিয়েছে, তার অবস্থানও কৌতূহলোদ্দীপক বৈকি! এক বিজেপি নেতা যেমন বলেছেন, ‘‘এই বাড়ির ছাদে উঠলে গঙ্গার উল্টো পারের নবান্ন দূরবীন ছাড়াই দেখা যায়!’’
বাড়ির নাম ‘আগরওয়াল হাউস’। ঠিকানা ২ নম্বর সেন্ট জর্জেস গেট রোড। ১০ তলা বাড়ির বেশ কয়েকটি তল ভাড়া নিয়ে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য রাজ্য বিজেপি-র দফতর তৈরি হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর রাজ্য সফরে এসে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা ওই দফতরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন বটে। কিন্তু বাড়ির কয়েকটি তলা বিজেপি ভাড়া নিয়েছে বছর দেড়েক আগেই। এখন বাড়ির নবম তলের গোটাটাই বিজেপি-র। সেখানে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় নেতা মুকুল রায়, শিব প্রকাশ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের আলাদা দফতর। ঠিক নীচে অষ্টম তলের অর্ধেকটা জুড়ে রাজ্য বিজেপি-র অন্যান্য নেতার আলাদা আলাদা বসার ঘর। চতুর্থ তলের একটি অংশে ক্যান্টিন আর পঞ্চম তলে সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য হলঘর।
সপ্তম তলেও বিজেপি-র কার্যালয় আছে। কিন্তু সেখানে কঠোর ভাবে প্রবেশ নিষেধ ‘সাধারণ’-এর। সংবাদমাধ্যমের তো নয়ই। এটিই রাজ্য বিজেপি-র মূল ‘ওয়ার রুম’। দল যার নাম দিয়েছে ‘কল সেন্টার’। লিফটে চ়েপে ওই সপ্তম তলে যাওয়াই যায়। কিন্তু ‘কল সেন্টারে’ ঢুকতে ‘বায়োমেট্রিক’ ব্যবস্থা পেরোতে হবে। সেখানে যাওয়ার অনুমতি দলেরও সকলের নেই। কর্মী ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন শুধু ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। লিফট থেকে সপ্তম তলে নেমে বাঁদিকে ঘুরলেই সেই ঘর। কাচের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে যেটুকু দেখা যায়, তাতে সার সার কম্পিউটারের সামনে শ’দেড়েক কর্মী। কানে হেডফোন। অনবরত ‘অন লাইন’। বিজেপি সূত্রের খবর, এঁরা সকলেই বেতনভুক কর্মী। বিধানসভা নির্বাচনের জন্যই এঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। দলের সদস্য হওয়ার জন্য যাঁরা ফোন করেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা কিংবা দলের তরফে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্যই এই ‘কল সেন্টার’। যা চলে একেবারে ‘পেশাদার এবং কর্পোরেট’ চলনে। তবে এমন উদ্যোগ রাজ্য বিজেপি-তে নতুন নয়। গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ও এই ধরনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তার ঠিকানা ছিল ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনে সদর দফতরের একটি ঘর। এ বার যেটা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার কথায়, ‘‘এ বার লড়াই অনেক বড়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ছিল সেমিফাইনাল। এ বার ফাইনাল ম্যাচ। দলও এখন রোজ বড় হচ্ছে। তাই বড় কার্যালয়। তাই এমন সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত কল সেন্টার।"
সদর দফতরের পরিচয় দিতে বসলে এখনও পর্যন্ত কলকাতায় আয়তনে সবচেয়ে ছোট কার্যালয় শাসকদল তৃণমূলেরই। তপসিয়ায় তৃণমূল ভবন মাত্রই তিন তলা একটি বাড়ি। প্রথম দু’টি তলে হয় দলের কাজ আর একেবারে উপর তলায় নেতানেত্রীদের থাকার জায়গা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম রাজ্য দফতর মুজফ্ফর আহমেদ ভবন চার তলার বাড়ি। আর সিআইটি রোডে কংগ্রেসের বিধান ভবন পাঁচ তলা। বস্তুত, বিজেপি-র সদর দফতরটিও খুবই ছোট এবং পুরনো। এখন হেস্টিংসে নির্বাচনী কার্যালয় হলেও ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেন ছাড়তে চায় না পুরনো ভাড়াটিয়া বিজেপি। দলের নেতারা বলেন, বিজেপি-র আদিপুরুষ তথা জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও এক সময় এই দফতরে বসেছেন। ফলে সেটি ছাড়া চলবে না। তাঁদের আরও যুক্তি, ওই ছোট দফতর থেকেই এত বড় হয়েছে বিজেপি। এখন ‘সুখের দিনে’ পুরনোকে ভুললে চলবে কেন!
রাজ্য দফতরের পাশাপাশি রাজ্য বিজেপি-র বড় দফতর তৈরির উদ্যোগ মূলত শুরু হয় বাংলার পর্যবেক্ষক হিসেবে কৈলাস দায়িত্ব নেওয়ার পরেই। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। ঠিক ছিল, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই সদর দফতরের পাশে ১২ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের একটি বড় বাড়ি নেওয়া হবে। কিন্তু ওই বাড়িটি নিয়ে নানা শরিকি গোলমাল থাকায় শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান রাজ্য নেতারা। এর পরে রাজ্য দফতরের ছোট পরিসর থেকেই ২০১৬ সালের বিধানসভা এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পরিচালনা করে গেরুয়া বাহিনী। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেকটাই ‘ব্রাত্য’ ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের রাজ্য দফতর। আপাতত ওখানে শুধুই কলকাতা জোনের নির্বাচনী কার্যালয়। বাকি বাংলার লড়াই হবে হেস্টিংসের অফিস থেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy