দিন বারো আগে পরিবহণমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখুন, অটোয় বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’
ভুক্তভোগীরা জানেন, বন্ধ হয়নি।
পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী কয়েক দিন ধরেই আশ্বাস দিচ্ছিলেন, অটোরিকশায় শৃঙ্খলা আনতে কড়া নিয়মনীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে।
কিন্তু রাজ্য সরকারের খসড়া অটো-নীতিতে যাত্রীদের সমস্যার সুরাহার তেমন আশ্বাসই মিলল না। বরং রাজ্যের কয়েক লক্ষ অটোচালক এবং তাঁদের পরিবারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি না-নিয়ে কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবস্থাকেই সিলমোহর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ওই খসড়ায়।
ইচ্ছে-খুশি ভাড়া নেওয়া, কাটা-রুটে চালানো, কাটা-গ্যাসে চালানো— সব রোগই যে অটোর রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ-সবে লাগাম পরানোর কোনও দিশা মেলেনি খসড়া নীতিতে। অটোচালকদের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বেশি অভিযোগ অভব্য আচরণ নিয়ে এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানো নিয়ে। অবিলম্বে এই দু’টি অসুখের জুতসই দাওয়াই চাইছিলেন আমযাত্রীরা। যাত্রীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, সেই ব্যাপারে অটোচালকদের প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু অটোর অভব্যতা আর দাদাগিরির রুখতে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা স্পষ্ট নয় খসড়া অটো-নীতিতে। ফলে অটো-নীতি নিয়ে সরকারি স্তরে যতই হইচই হোক, সাধারণ যাত্রীদের আখেরে কতটা লাভ হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পুরনো ব্যাধি যে এক দিনে সারে না, সেই স্তোকবাক্য আউড়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে কর্তাদের তরফে। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এত দিনের কু-অভ্যাস এক দিনে পাল্টে যাবে, এমনটা ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। সরকার চেষ্টা করছে। ধাপে ধাপে অটো-পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।’’
ইচ্ছেমতো হুটহাট ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়াটা অটোর অন্যতম অসুখ। উৎসবের মরসুমে বোনাসের নামে অনেক রুটে বাড়তি ভাড়া আদায়ের খবর পেয়ে পরিবহণমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, যখন খুশি ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নেওয়া হবে না। কিন্তু মন্ত্রীর হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না-করে বিভিন্ন রুটে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে লাগামহীন ভাবে। এক শ্রেণির অটোচালক ঘোষণাই করে দিয়েছেন, মন্ত্রী-নেতা চেনেন না তাঁরা। চেনেন শুধু ইউনিয়ন এবং সেই জোরেই বাড়তি ভাড়া নেওয়া চলছে, চলবে। অটোর কিছু রুটে যে হঠাৎই ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মঙ্গলবার প্রকাশিত খসড়া অটো-নীতিতে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই অসুখ সারাতে সরকারের দাওয়াই কী এবং কবে সেটা প্রয়োগ করা হবে, খসড়ায় তার কোনও উল্লেখ নেই। উল্টে রাজ্য সরকার নিজেরা অটোর ভাড়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব না-নিয়ে রাশটা রেখে দিচ্ছে ইউনিয়নের হাতেই।
খসড়ার কয়েক দফা
• চার জনের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না
• অটোয় মিউজিক সিস্টেম নিষিদ্ধ
• আলোকসজ্জাও বারণ
• সময়সীমা বেঁধে অবৈধ অটোকে বৈধ করা
• কাটা-রুট নয়
• চাহিদা বুঝলে নতুন রুট
• প্রয়োজনে অটোর সংখ্যা বাড়বে-কমবে
বাস-মিনিবাসের মতো অটোরও রুট নির্দিষ্ট করা থাকে। নির্ধারিত সেই রুটের আগাগোড়া যাত্রী বহন করাটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু খাস কলকাতাতেই সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। যে-রুটে অটো চালানোর কথা, অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা নিজেদের সুবিধামতো তা কেটেছেঁটে নিচ্ছেন। নবান্নের একাধিক কর্তা জানাচ্ছেন, অতীতে একাধিক বার কাটা-রুট নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও পরিস্থিতি যে-কে-সেই রয়ে গিয়েছে। ফলে অটোর ইচ্ছেমতো সফরের সেই দাদাগিরিকে বাগে আনা যাবে, খসড়া নীতি ঘোষণা সত্ত্বেও সেটা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ রুট কেটে দিয়ে, ইচ্ছেমতো রুট ভেঙে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অনিয়মের মোকাবিলা করার কোনও চেষ্টাই হচ্ছে না। উল্টে কাটা রুটের চাহিদা বুঝে নতুন রুট তৈরির ভাবনা যে সরকারের রয়েছে, খসড়া অটো-নীতিতে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে পরোক্ষে রুট কেটে অটো চালানোর প্রবণতাতেই ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবহণকর্তাদের একাংশ।
ঘটনাচক্রে খসড়া নীতি প্রকাশের দিনেই অটোর বেপরোয়াপনার ছবি আরও এক বার দেখা গেল কলকাতায়। এ দিন রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট এবং বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে বেপরোয়া অটোর ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে ৮২ বছরের এক বৃদ্ধের। যার রেশ টেনে প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ বলছেন, অটোয় মিউজিক সিস্টেম বাজানো কিংবা চড়া আলো ব্যবহারের উপরেই শুধু নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু যাত্রীদের অভিযোগ সব চেয়ে বেশি অটোচালকদের অভব্য আচরণ এবং বেপরোয়া দৌড় নিয়ে। নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অটো চালালে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, তা স্পষ্ট নয় অটো-নীতিতে।
সরকারি ভাবে এটাও মেনে নেওয়া হয়েছে যে, কলকাতা এবং লাগোয়া জেলায় অনেক অটো চলছে বৈধ নথিপত্র ছাড়াই। যথাযথ পরিসংখ্যান দিতে পারছেন না কেউ। তবে নবান্নেরই কোনও কোনও কর্তা স্বীকার করে নিচ্ছেন, কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে বৈধ অটো যত আছে, বেআইনি অটো তার থেকে কিছু কম নয়। সেই সব অবৈধ অটোর দাপটের মোকাবিলা কী ভাবে করা হবে, তার হদিস নেই খসড়া নীতিতে।
এ দিন পরিবহণ দফতর যে-খসড়া নীতি প্রকাশ করেছে, তাতে অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে ১৩ দফা দাওয়াইয়ের কথা বলা হয়েছে ঠিকই। তবে তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাওয়াইয়ের অছিলায় অটোর অনিয়মকেই নিয়ম হিসেবে বৈধতা দেওয়া চেষ্টা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে পারমিটহীন অটোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারমিট দেওয়ার কথা। রয়েছে সরকারি নথিতে অন্তর্ভুক্ত না-হয়ে থাকলে সেই অটোকে নথিভুক্ত করে নেওয়ার কথাও। বলা হয়েছে, প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন রুট তৈরি করে নেওয়া হবে। নয়া অটো-নীতিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কলকাতা, হাওড়া, বিধাননগর, হুগলি এবং দুই ২৪ পরগনায় গ্যাসের অটো ছাড়া অন্য কোনও অটো চলতে দেওয়া হবে না। সব অটোয় লাগাতে হবে হাই-সিকিওরিটি নম্বর প্লেট। চালকদের ঝোলাতে হবে পরিবহণ দফতরের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ড্রাইভার-ব্যাজ।
এগুলো দরকার। কিন্তু এগুলো যে মূল অসুখ নিরাময় করার দাওয়াই হতে পারে না, সেটা মেনে নিচ্ছেন পরিবহণ দফতরের অনেক কর্তাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy