গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুজোয় ঠাকুর দেখতে যান?
— হ্যাঁ, কেন যাব না! যাই তো। গ্রামে যাই। গ্রামের বাইরেও যাই।
প্রসাদ খান?
জবাবের আগে ঘরের ভিতর থেকে ঝাঁঝালো নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘‘আবার! ঘুরেফিরে আবার সেই খাওয়ার কথা? উনি কোনও কথা বলবেন না! যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে!’’ কয়েক লহমার বিরতি। নেপথ্যভাষণ আরও এক পর্দা চড়ল, ‘‘অ্যাই! তুমি আর একটা কথাও বলবে না! যাও! স্নানে যাও!’’ এতটাই লোক-খেদানো সেই গলা যে, পুরুষকণ্ঠের স্বগতোক্তি— ‘‘আর পুজো! লোকজন কী ভাবে তাকাত। কী সব বলত! মোবাইল খুললেই মিম। ব্যঙ্গ! হাসি! মরেই তো গিয়েছিলাম’’, শোনাই গেল না প্রায়।
উৎসবের মরসুমে ভুরকুন্ডার বাগপাড়া একেবারে সুনসান। ভাল করে কান পাতলে কাছের বামনডাঙার প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা মাইকের গানটুকু আবছা শোনা যায়। আঁকাবাঁকা পিচঢালা সরু রাস্তার পাশে খোলা উঠোনের এক কোণে মুদির দোকান। অর্ধেক ঝাঁপ তোলা। বাকিটা ঢাকা কালো প্লাস্টিকে। অন্য পাশে কোনও দেওয়াল ছাড়া মাঝারি চেহারার টিনের চালের একটা কাঠামো। ভিতরে খানতিনেক ছাগলছানা খেলে বেড়াচ্ছে।
দোকান আর ওই কাঠামোর মাঝে ফুট চারেক চওড়া ঢালাই রাস্তা। সে পথে গেলে বাঁ হাতে চুনকাম করা দোকান-দেওয়ালে বড় করে আঁকা তৃণমূলের ঘাসফুল। ‘গ্রামে’ সেই চিহ্নে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিরাট করে লেখা, ‘মহাদেব মাটি’।
মহাদেববাবু বাড়ি আছেন?
পিচ রাস্তা থেকেও দেখা যায় কয়েক পা এগোলে দু’ঘর-এক বারান্দার প্লাস্টার না-হওয়া পাকা বাড়িটা। কোলাপসিব্ল গেট আর বারান্দা-ঘেরা গ্রিলের গায়ে এখনও রং পড়েনি। হাট করে খোলা সেই কোলাপসিব্ল গেট।
ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন গৃহিণী। নীল-সাদা ফুলছাপ শাড়ি। আটপৌরে করে পরা। পিছন পিছন আদুল গায়ে তিনি। পরনে শুধু লাল-সবুজ-সাদা মিশেল চেকের একটা গামছা। চুলে সদ্য রং চাপিয়েছেন। জুলপি বেয়ে সেই রং গড়িয়ে আসতে চাইছে গালে। তবে আগন্তুককে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া মানা। মহিলা সাফ বললেন, ‘‘উনি কোনও কথা বলবেন না! ওই এক খবরে আমাদের সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আমাদের আর কোনও কথা নেই। সাংবাদিকের সঙ্গে তো নয়ই।’’
গত ১১ জুলাই পঞ্চায়েত ভোটের ফলপ্রকাশের দিন বিকেলে আচমকা গোটা রাজ্যে নাম ছড়িয়ে পড়েছিল এই মহাদেবের। জীবনে প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ভোটের গণনাই মহাদেবকে ‘বিখ্যাত’ করে দিয়েছিল। অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া-২ ব্লকের ভুরকুন্ডা পঞ্চায়েতের ৩১ নম্বর বুথের ভোট পুনর্গণনার সময় মহাদেব গণনাকেন্দ্রের ভিতরেই বেশ কয়েকটি ব্যালট চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যার ফলে ভুরকুন্ডায় ভোটের ফল ভন্ডুল হয়ে যায়। এখনও ওই বুথে কে জয়ী, তা ঘোষিত হয়নি। মামলা গড়িয়েছে হাই কোর্ট পর্যন্ত।
মহাদেব অবশ্য বরাবর ব্যালট খাওয়ার বিষয়টা অস্বীকারই করেছেন। তাঁর বরং দাবি, তিনি ৪৬ ভোটে জিতছিলেন বলে বিরোধীরা ওই অপপ্রচার চালিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমও ভুল খবর দিয়েছে। কিন্তু মহাদেবের প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের রবীন মজুমদার বা বিজেপি প্রার্থী সন্ন্যাসী মাটি (যিনি সম্পর্কে মহাদেবের দাদা) শুনলে তো! তাঁদের দাবি, ৪ ভোটে হেরে যাওয়া মহাদেব সব ভন্ডুল করতেই ব্যালট চিবিয়ে খেয়েছেন।
সেই থেকে জীবনটাই মাটি হয়ে গিয়েছে মহাদেব মাটির।
‘‘একটা খবর আমাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে! তখন মনে হত, আত্মহত্যা করি! কিন্তু সন্তানদের কী হবে ভেবে পিছিয়ে এসেছি! দিনের পর দিন লুকিয়ে থেকেছি। কেঁদেছি। বাইরে বেরোইনি। আর ও সব নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না’’, এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন মহাদেব। একটু থেমে, ‘‘এতে দলের বিড়ম্বনাও বাড়ে। নেতারা এ সব নিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। আমরা খুব গরিব। কোনও রকমে দিন চলে। গ্রামের লোকের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াই। আমার আর কিছু চাই না। কোর্ট কিছু নির্দেশ দিয়েছে। আমি কোনও কথা বলব না। আপনি এখন আসতে পারেন!’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কী ভাবে বদলে যায় একটা মানুষের জীবন! বদলে যায় একটা গোটা পরিবারের জীবন আর তাদের পরিপার্শ্ব!
তখন সদ্য সদ্য ঘটনাটা ঘটেছে। দিঘির ঘাটের বাজারে তাঁর মাছের দোকানে বসেছিলেন মহাদেব। এক ক্রেতা এসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘কী রে, এই মাছটাও কি ব্যালট খেয়েছে? পেটটা এত মোটা!’’ দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন মহাদেব। বেশ কিছু দিন আর দোকান খোলেননি। কাছের স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে তাঁর ছেলে। সে-ও বেশ কিছু দিন স্কুলে যেতে পারেনি বাবাকে নিয়ে মশকরার ঠেলায়। মহাদেব এখন বাতাসে প্রশ্ন ছোড়েন,‘‘ছেলেটা কী দোষ করেছে? ও তো বড় হয়েছে! ওর আত্মসম্মান বোধ আছে তো। একটা ভুল খবর আমাদের গোটা পরিবারকে শেষ করে দিল!’’
একটু বসা যাবে?
প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিলেন মহাদেব। কোলাপসিব্ল গেটের গা ঘেঁষে। চেয়ারটা অগ্রাহ্য করে জানানো গেল, বরং পা ঝুলিয়ে গ্রিলের স্ল্যাবে বসাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। সামনের চেয়ারে বসলেন মহাদেব। কিন্তু পরমুহূর্তেই জানালেন, তাঁকে বেরোতে হবে। স্নানে যাবেন। আর কোনও সময় দিতে পারবেন না।
এক কাপ চা হবে?
জবাব এল ভিতরের ঘর থেকে। নারীকণ্ঠে, ‘‘আপনারা খুবই ভাল মানুষ। কিন্তু উনি কোনও কথা বলবেন না। আপনাকে তো অনেক বার বললাম। এ বার আসুন!’’ শুনতে শুনতে গলার স্বরটা একটু নামিয়েই মহাদেব বললেন, ‘‘একটু এগিয়ে গেলেই মাদ্রাসা মোড়ে চায়ের দোকান পাবেন।’’
চায়ের দোকানে দুপুরের আড্ডা বলল, ‘‘ছেলেটা খুবই ভাল। লোকের বিপদে-আপদে পাশে থাকে। দৌড়ে যায়। পয়সাকড়ি নেই। দিন আনে দিন খায়। বাজারে মাছের দোকান আছে একটা। আর বাড়িতে মুদির দোকানটা ওর বৌ স্বপ্না চালায়। দলটা মন দিয়ে করে।’’ কিন্তু সেই ভিড়ও জানে মহাদেবের ব্যালটভোজের কথা। সেই ভিড় হাসতে হাসতে বলে, ‘‘মাত্র ৪ ভোটে হারছিল! তখন আর মাথার ঠিক থাকে! দিয়েছে সব ঘেঁটে।’’
ফেরার মুখে টের পাওয়া গেল, মহাদেব তত ক্ষণে গ্রিল-দরজা দিয়ে উঠোনের মাঝখানের কলপাড়ে। বালতি ভরছেন। একেবারে তাঁর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা গেল, ‘‘তবে কি আপনার পুজোটাই মাটি এ বার?’’ ঠিক তখনই স্বপ্না ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে দোকান ঘরে যেতে যেতে সেই ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘‘কেন? আমরা কি চুরি করেছি? উনি কি খুন করেছেন? পুজো মাটি কেন হবে!’’
পুজোয় ঘুরতে যাবেন?
প্রশ্ন এবং জবাবের মাঝে হুড়ুশ করে বালতির জল মাথায় ঢাললেন মহাদেব। চুলের আলগা রং মুখ থেকে গড়িয়ে গলা দিয়ে বুক বেয়ে নামছে। জলে-রঙে মিশে নীলকণ্ঠ লাগছিল মহাদেবকে। জবাব এল, ‘‘ঘুরতে তো সবাই যায়। আমরাও যাব।’’
কোথায় যাবেন?
উত্তর দিলেন স্বপ্না, ‘‘হাবড়া, অশোকনগর, বারাসত, গোবরডাঙা— সব জায়গায় যাব। ঠাকুর দেখতে যাব। মায়ের কাছে যাব। আপনাদের আপত্তি আছে? চিনলে চিনবে!’’
ভুরকুন্ডা পঞ্চায়েতের সামনে গ্রামেরই বামনডাঙার পুজো। সেখানে যাবেন না? দিঘির ঘাটের পুজোয়? তাঁর গ্রামের দুটো পুজোই তো তাঁর বাড়ি থেকে মেরেকেটে এক কিলোমিটার। আরও এক বালতি জল মাথায় ঢাললেন মহাদেব। নীরবে। এ বার নীরব স্বপ্নাও। দোকান থেকে উঠোন পেরিয়ে সটান ঘরে চলে গেলেন। এক বার দাঁড়ালেনও না।
অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য চারদিকে। সেটা ফেলে রেখে দু’পা এগোতেই পিছন থেকে ডাকলেন মহাদেব, ‘‘রাগ করবেন না। খারাপ লাগাবেন না। আমি খুব খারাপ ছিলাম। এ সব কাটিয়ে উঠতে চাই। পুজোর আনন্দের মধ্যে যদি আবার কেউ ওই অসহ্য দিনগুলো ফিরিয়ে দেয়, ভাল লাগবে? আপনিই বলুন!’’
পঞ্চায়েতে ব্যালটভোজের অতীতকে পিছনে ফেলে এসেছেন। জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তাঁর পুজো মাটি হতে দেবেন না মহাদেব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy