প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ইচ্ছানুযায়ীই তাঁর দেহদান করা হল এসএসকেএম হাসপাতালে। —ফাইল চিত্র।
লোকসভার স্পিকার পদে থাকাকালীন শেষ অধিবেশনের শেষ দিন তিনি বলেছিলেন, এই বয়সে নিজেকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করাই শ্রেয়। কথা রেখেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সক্রিয় রাজনীতিতে আর কোনওদিন ফেরেননি। আর মঙ্গলবার এমন এক অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিলেন যেখান থেকে আর কোনও দিনই ফিরবেন না। সকাল সওয়া ৮টায় প্রয়াণ। সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় এসএসকেএম হাসপাতালে দেহদান। মাঝে দিনভর তাবড় রাজনীতিবিদের শ্রদ্ধার বার্তা, বামেদের ভূমিকা নিয়ে পুত্র-কন্যার ক্ষোভ-অভিমান, আলিমুদ্দিনে দেহ না যাওয়া, বিধানসভায় গান স্যালুট, স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের কান্না, শেষবারের মতো বাড়ি ঘুরে গ্রিন করিডরে এসএসকেএম। রাত সাড়ে ৮টায় দেহদানের মধ্যে দিয়ে শেষ হল রাজনীতির এক অধ্যায়। যে অধ্যায়ে থেকে গেল এক বঙ্গসন্তানের রাজধানীর বুকে দৃপ্ত পদচারণা, বাম রাজনীতির দীনতা, আর রাজনীতির ঘেরাটোপে থেকেও ঋজু মেরুদণ্ডে সংসদীয় গণতন্ত্রের পতাকা ওড়ানোর দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস।
দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন ১৬ বছর আগে। তাই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অন্তিম যাত্রা যে সেখানেই শেষ হবে, সেটা জানাই ছিল। কিন্তু অজানা ছিল, জীবদ্দশায় যে সিপিএম তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে, বাংলার বর্ষীয়ান নেতারা বার বার দরবার করলেও যে সিপিএম তাঁকে দলে ফেরায়নি, মৃত্যুর পরও তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তাদের পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। যে বাম রাজনীতির প্রতি আজীবন একনিষ্ঠ থেকেছেন, বহিষ্কারের পরেও বাম রাজনীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, সেই সোমনাথবাবুর মরদেহই রাজ্য সিপিএমের সদর কার্যালয় আলিমুদ্দিনে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলেন বাম নেতৃত্ব।
দল তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহারই করুক, তিনি নিজে কখনও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। কোনও দিন কোনও ক্ষোভ-উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। তিনি সর্বংসহা হলেও আজীবন দলের জন্য লড়াই করে শেষ বয়সে এসে বাবার প্রতি এই অবিচার মেনে নিতে পারেননি সন্তানরা। ভিতরে ক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল। আলিমুদ্দিনে মরদেহ নেওয়ায় সায় না দেওয়া, গায়ে সিপিএমের পতাকা দেওয়ার প্রস্তাব পত্রপাঠ ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত যেন দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত সেই ক্ষোভ-অভিমান-অপমানের বহিঃপ্রকাশ হয়ে ঝরে পড়ল মেয়ে অনুশীলা বসুর গলায়। বিমান বসুকে মুখের উপর বাড়িতে ঢুকতে নিষেধ করে দিলেন সোমনাথ-পুত্র প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৯২৯-২০১৮)
আরও পড়ুন: দলের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন সংসদীয় দায়িত্ববোধ থেকেই
আরও পড়ুন: সবারই শোকবার্তা এল, সিপিএম শুধু দ্বিধা থরথর
দেখুন ভিডিয়ো
স্পিকার পদে থাকাকালীনই তাঁকে বহিষ্কার করে সিপিএম। ‘অপরাধ’, দল সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিলেও তিনি স্পিকার পদে থেকে গিয়েছিলেন। ‘অপরাধ’, দলের চেয়েও তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল সাংবিধানিক কাঠামো, পদের প্রতি সম্মান ও দায়বদ্ধতা। তার জেরে শেষ বয়সে এসে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। আর মৃত্যুর পর? শ্রদ্ধা জানাতে লেগে গেল পাঁচ ঘণ্টারও বেশি! বাম নেতাদের এ হেন দ্বিধাগ্রস্ততা, এ হেন সংকীর্ণ রাজনীতির দীনতা ধরা পড়ল প্রয়াণের পরও।
শেষশয্যায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
এ দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ সোমনাথবাবুর মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করা হয়। প্রথমে যায় কলকাতা হাইকোর্টে। সেখানে মিনিট পঁয়তাল্লিশ মরদেহ শায়িত রাখা হয়। এর পর সোমনাথবাবুর মরদেহ বিধানসভায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় সহ মন্ত্রী-বিধায়করা। সেখানেই গান স্যালুট দেওয়া হয় লোকসভার প্রয়াত প্রাক্তন স্পিকারকে।
লোকসভার প্রাক্তন স্পিকারকে শেষ শ্রদ্ধা বর্তমান স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের। —নিজস্ব চিত্র।
সকাল ৮টা নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত ঘোষণার পর থেকেই শোকের ছায়া নেমে আসে রাজনৈতিক মহলে। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী— সোমনাথবাবুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রায় সকলেই। খবর পাওয়ার পরই তড়িঘড়ি হাসপাতালে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী জানান, সোমনাথবাবুকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দেওয়া হবে।
বিধানসভায় গান স্যালুটের পর সেখান থেকে সোমনাথবাবুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজা বসন্ত রায় রোডে তাঁর বাড়িতে। সেখানে পৌঁছে সোমনাথবাবুকে শ্রদ্ধা জানান লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। সন্ধ্যার দিকে আসেন সীতারাম ইয়েচুরিও।
এরপর বাসভবন থেকে মরদেহ রওনা দেয় এসএসকেএম হাসপাতালের পথে। গোটা রাস্তা গ্রিন করিডর করে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর দেহ। সেখানে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ দেহদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy