সবুজের চাদর: জলপাইগুড়ি বললে প্রথমেই মনে আসে যে চা বাগান।—নিজস্ব চিত্র।
বড় মায়া মাখিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বর্ণনা করেছিলেন ত্রিস্রোতা নদীর। অনেকে যে নদীকেই তিস্তা বলে মনে করেন। মনে করেন, এই নদীর ধারেই বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানির বজরা বাঁধা থাকত। তাই মতো, দেবীর বাস জলপাইগুড়িতেই। সেই ত্রিস্রোতার বিবরণ দিতে গিয়ে বঙ্কিমের লেখায় অপরূপ বর্ণনা রয়েছে এই এলাকার—‘‘জ্যোৎস্না এমন বড় উজ্জ্বল নয়, বড় মধুর, একটু অন্ধকারমাখা–পৃথিবীর স্বপ্নময় আবরণের মতো। ত্রিস্রোতা নদী জলপ্লাবনে কূলে কূলে পরিপূর্ণ। চন্দ্রের কিরণে সেই তীব্রগতি নদীজলের স্রোতের উপর–স্রোতে, আবর্তে, কদাচিৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে জ্বলিতেছে।...তীরে, গাছের গোড়ায় জল আসিয়া লাগিয়াছে–গাছের ছায়া পড়িয়া সেখানে জল বড় অন্ধকার; অন্ধকারে গাছের ফুল, ফল, পাতা বাহিয়া তীব্র স্রোত চলিতেছে; তীরে ঠেকিয়া জল একটু তর-তর কল-কল পত-পত শব্দ করিতেছে–কিন্তু সে আঁধারে আঁধারে।...কূলে কূলে অসংখ্য কল-কল শব্দ, আবর্তের ঘোর গর্জন, প্রতিহত স্রোতের তেমনি গর্জন; সর্বশুদ্ধ একটা গম্ভীর গগনব্যাপী শব্দ উঠিতেছে।’’ আবার সেই নদীই ‘শুকার সময়’ হেঁটে পার হওয়া যেত।
এই রাজকীয় ঐশ্বর্য যে জেলার, সেখানে জনপদের ইতিহাস কত পুরনো, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলা তৈরি হল রংপুর জেলার একটা অংশ নিয়ে। জুড়ল বোদা, পচাগড়, তেঁতুলিয়া, পাটগ্রাম ও দেবীগঞ্জ। তিস্তার পশ্চিমপাড়ের এই পাঁচটি থানা, যা রংপুরের অন্তর্গত, তাদের পূর্বপাড়ে ১৮টি, ডুয়ার্সের ১১টি থানা নিয়ে প্রশাসনিক ভাবে জন্ম নিল জেলা। আগে যেটা ছিল ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স, যার সদর দফতর ছিল ময়নাগুড়ি, সেটা ছিল একটি জেলা। যা ভুটান যুদ্ধের পরে ১৮৬৫ সালে তৈরি হয়। এদিকে আলিপুরদুয়ার (ভলকা দুয়ার পরগনা), যা হেদায়েৎ আলির নামানুসারে ছিল, তা হল মহকুমা। এই নাম নিয়ে দ্বিমতও আছে। বোড়োরা দাবি করেন, প্রথম যে মেচ মুসলিম হয়েছিলেন, সেই আলি মেচের নামানুসারের নাম হয় আলিপুরদুয়ার। এই জেলা বঙ্গদেশের একমাত্র জেলা, যেখানে দু’রকম প্রশাসন প্রচলিত ছিল জেলা গঠনের পরে। তিস্তার পশ্চিমপাড় ছিল ‘রেগুলেটেড এরিয়া’। এখানে বঙ্গদেশ সরকারের আইন, রীতি, বিধির প্রচলন ছিল। এদিকে তিস্তার পূর্বপাড় ছিল ‘ননরেগুলেটেড এরিয়া’। এখানকার শাসনব্যবস্থা চলত গভর্নর জেনারেল দ্বারা। শাসনপ্রক্রিয়া চলত ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেই। সেই জন্য জলপাইগুড়ি জেলাশাসককে ডেপুটি কমিশনার বলা হত। ডুয়ার্সের লোকের ভোটাধিকার ছিল না।
আরও পড়ুন: হ্যামিল্টনগঞ্জের কাছেই কুটুমবাড়ি ইষ্টিকুটুম
হিমালয়ের সানুদেশ থেকে বোদা, পাটগ্রাম, পচাগড় সমতল, অর্থাৎ, জেলার এক দিকে হিমালয় আর এক দিকে তিস্তা, করতোয়া বেষ্টিত সমভূমি অঞ্চল। তখন প্রতিবেশী ভুটান আর তিব্বত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ভুটানের প্রবেশের একমাত্র রাস্তা হল জলপাইগুড়ি দিয়ে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা। জেলা গঠনের পূর্বে ডুয়ার্সে ছিলেন মুসলিম ও মেচ জনজাতির মানুষ। ছিলেন টোটো, রাভা ইত্যাদি জনজাতির লোকেরাও। রাজবংশী জনজাতির মানুষ সংখ্যায় কম ছিলেন। ১৮৬৪-’৬৯ সালের মধ্যে ময়নাগুড়িতে একটি বড় জনপদ গড়ে ওঠে, সেখানে অভিবাসীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। অভিবাসীদের অধিকাংশই ছিলেন পাবনা, দিনাজপুর, ঢাকা, রংপুরের মানুষ।
ঐতিহ্য: গরুমারা জাতীয় উদ্যান।—নিজস্ব চিত্র।
তিস্তার পশ্চিমপাড় ছিল কৃষিভিত্তিক অঞ্চল আর ডুয়ার্স ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। সেখানে জনবসতি ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭৬ জন।
ঠাঁই বদলে জেলাসদরটি ময়নাগুড়ি থেকে এল জলপাইগুড়িতে। প্রশাসনিক গুরুত্ব বাড়ল। তার একটা কারণ হল, এই জেলাটি ছিল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত, সদর দফতর ছিল বহরমপুর। বহরমপুর থেকে এই অঞ্চলে শাসন করা সম্ভব ছিল না। সব থেকে বড় কারণ ছিল ভুটান যুদ্ধে হেরে গেলেও ভুটানের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যই তিস্তার পশ্চিমপাড়কে জেলাসদর করা হল। কারণ, ইংরেজদের ভয় ছিল, যদি ভুটান আবার আক্রমণ করে! এবং এই কারণে জেলা গঠনের সাত বছরের মধ্যে রাজশাহী বিভাগের সদর দফতর বহরপুরের বদলে হল জলপাইগুড়ি। সেটা ১৮৭৫ সাল।
জেলা গঠন হল, কিন্তু সরকারের তেমন কোনও রাজস্ব আয় হত না। সেই কারণে সরকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষকদের বলল ডুয়ার্সে এসে (ননরেগুলেটেড এরিয়া) বসবাস করতে, মকুব করল তিন বছরের খাজনা। পাশাপাশি জানাল, বিনা মূল্যে মিলবে জ্বালানিও। সেই সময় ব্রিটিশ সরকারের মাথায় এল, দার্জিলিং ও অসমের মতো চা-বাগান পত্তন করলে কেমন হয়। এখানে চা-বাগান করার সুবিধা বলতে ছিল খাসমহল জমি। যা ‘লিজ’ দিতে সুবিধা হত। পাশাপাশি কৃষকদেরও উৎখাত করার বিষয় ছিল না। কারণ, কৃষিজীবী বলতে কিছু ছিল না। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ১৮৭৬ সালে গজলডোবায় স্থাপিত হল জেলার প্রথম চা-বাগানটি। চা-বাগান সূত্রে জেলার অর্থনীতিতে এক নতুন প্রবাহ তৈরি হল। এই প্রবাহের অংশীদার শুধু ইউরোপীয়রাই নন, দেশীয় উদ্যোগীরাও এই চা-শিল্পের সঙ্গে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকলেন। সেই সময় জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু (১৮৭৪-৭৮)। তাঁর সূত্রেই উদ্যোগীরা উৎসাহিত হলেন, জমির ‘লিজ’ পেতে তিনি বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত।
আরও পড়ুন: বৃষ্টিভেজা রূপসী বগুরান
এই জেলার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ বন। যেহেতু এই অঞ্চলটি ইংরেজদের অধিকৃত ছিল না, তাই ব্রিটিশরাজের বননীতি প্রয়োগ হয়নি। জেলা গঠনের পরে এই বন বা জঙ্গল অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত হল। বনজ সম্পদ, মানে, কাঠ ব্যবহৃত হল রেললাইনের স্লিপার নির্মাণে। তামাকের চাষ আগে থেকে চালু থাকলেও তা বাণিজ্যিক ভাবে প্রসারিত হল। এই জন্য এই জেলাকে বলা হয় টি, টিম্বার, টোব্যাকোর জেলা।
জেলার অর্থনৈতিক পরিবর্তন হল বটে, কিন্তু স্থানীয়দের তাতে আগ্রহ ছিল না, তাঁরা প্রয়োজনও বোধ করেননি। এ কারণে ছোটনাগপুর থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হল। এই শ্রমিক আসার ফলে শুধু ডুয়ার্স নয়, জেলার জনবিন্যাসে এক অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দিল। রাজশাহী বিভাগের সদর দফতর জলপাইগুড়ি হওয়ার এক দশক পরেই গঠিত হল জলপাইগুড়ি পুরসভা। শহরে গড়ে উঠল ইউরোপীয় ক্লাব, গির্জা। সাহেবদের জন্য তৈরি হল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। রেসকোর্স হল। দেখা গেল, দার্জিলিংয়ের পরে সবচেয়ে বেশি ইউরোপীয় এই শহরেই বাস করতে লাগলেন। শহরের যে অংশে সাহেব পাড়া গড়ে উঠেছিল, সেখানে এক সময় নেটিভদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। এই সময় জলপাইগুড়িকে বলা হত সবুজ উপনিবেশের রাজধানী বা টি-টাউন।
শিক্ষার চিত্রও বদল হল। তৈরি হল স্কুল। চা-বাগানে নাটক, খেলাধুলার প্রসার ঘটল। এদিকে শহরে গড়ে উঠল নাট্য প্রতিষ্ঠান ‘আর্যনাট্য সমাজ’ (১৯০৪)। সেই সময়ে উত্তরবঙ্গে কোনও নাট্যসংস্থা ছিল না। তিস্তার পশ্চিমপাড়ের একটা বড় অংশ ছিল বৈকুণ্ঠপুর রায়কত জমিদারদের জমিদারির অংশ। যাঁরা ৩২ হাজারি জমিদার নামে পরিচিত ছিলেন। কারণ, তারা ৩২ হাজার টাকা রাজস্ব দিতেন কোম্পানিকে। কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা-পর্বে এই বৈকুণ্ঠপুর রায়কতদের রাজধানী ছিল বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের সুবর্ণপুর অঞ্চল।
(মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং সহ উত্তরবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy