Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

প্রেমিকের হাতে খুন, ট্রাঙ্কে ‘মমি’ হয়ে রইল আকাঙ্ক্ষা

গত বছর দু্র্গাপুজোর সপ্তমীর ক’দিন আগেই যে যুবক তাঁদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিল, সেই-যে তাঁর মেয়ের খুনি, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি শিবেন্দ্র শর্মা। বুঝলেন, তারও তিন মাস কেটে যাওয়ার পর। বাঁকুড়া জেলা পুলিশের একটি দল ওই যুবকের বাড়ি থেকে একটি কঙ্কাল উদ্ধারের পরে।

আকাঙ্ক্ষা শর্মা

আকাঙ্ক্ষা শর্মা

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৭
Share: Save:

গত বছর দু্র্গাপুজোর সপ্তমীর ক’দিন আগেই যে যুবক তাঁদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিল, সেই-যে তাঁর মেয়ের খুনি, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি শিবেন্দ্র শর্মা। বুঝলেন, তারও তিন মাস কেটে যাওয়ার পর। বাঁকুড়া জেলা পুলিশের একটি দল ওই যুবকের বাড়ি থেকে একটি কঙ্কাল উদ্ধারের পরে। বাবা জানলেন, আমেরিকায় চাকরি করতে যাচ্ছেন বলে যে মেয়ে গত জুনে বাড়ি ছেড়েছিলেন, তিনি আসলে ছিলেন ভোপাল শহরে। ‘প্রেমিকের’ কাছে।

এই ঘটনা হইচই ফেলে দিয়েছে গোটা দেশেই। কী ভাবে এক যুবক ওই তরুণীকে মেরে মাসের পর মাস নিহতেরই মোবাইল থেকে হোয়্যাটস অ্যাপ করে তাঁর পরিবারকে বোকা বানিয়েছে, তা জেনে তাজ্জব তদন্তকারীরা। মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের গোবিন্দনগর থানার সাকেতনগরের একটি বাড়িতে হানা দিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মেঝে খুঁড়ে একটি দেহ উদ্ধার করে বাঁকুড়া পুলিশ। ওই বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয় খুনের মূল অভিযুক্ত, উদয়ন দাসকে। দেহটি আকাঙ্ক্ষারই বলে ধৃত জানালেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করাবে পুলিশ। দেহ পোরা হয়েছিল টিনের ট্রাঙ্কে। তার মধ্যে ফেলা হয় সিমেন্ট গোলা। ফলে দেহ কংক্রিটের ‘মমি’র আকার নিয়েছিল বলে জানান তদন্তকারীরা। পাঁচ ফুটের দেহটি ট্রাঙ্কে আঁটানোর জন্য মুন্ডু ও পা মুড়ে দেওয়া হয়।

বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা শুক্রবার বলেন, ‘‘জেরার মুখে উদয়ন ওই তরুণীকে খুন করার কথা কবুল করেছে। ধৃতকে ট্রানজিট রিমান্ডে বাঁকুড়ায় নিয়ে আসা হচ্ছে।’’

নিহত তরুণীর বাবা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বাঁকুড়া জেলার চিফ ম্যানেজার। বাড়ি পটনায়। বছর দুয়েক আগে এখানে বদলি হয়ে এসে বাঁকুড়া শহরের রবীন্দ্র সরণিতে দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সপরিবার থাকছিলেন শিবেন্দ্রবাবু। সঙ্গে আঠাশ বছরের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা, তাঁর দাদা আয়ুষ এবং মা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগে চাকরির খোঁজে দিল্লিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান আকাঙ্ক্ষা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ ভোপালের উদয়নের সঙ্গে।

শিবেন্দ্রবাবু জানান, গত জুনে আকাঙ্ক্ষা বলেন, তিনি ইউনিসেফে চাকরি পেয়েছেন। শীঘ্রই আমেরিকা যেতে হবে। তার পরে আকাঙ্ক্ষা বাঁকুড়ার বাড়িতে এসেছিলেন। ২৩ জুন ফের দিল্লি যান। এর পরে এক-দু’বার ফোন করেছিলেন বাড়িতে। আর নয়। জুলাইয়ের গোড়ায় ওই তরুণীর মোবাইল থেকে হোয়্যাটস অ্যাপ মেসেজ আসে, তিনি আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছেন। তার পর থেকে মেয়ের মোবাইলে বারবার ফোন করলেও তা বেজে গিয়েছে। আকাঙ্ক্ষা কখনওই ফোন তোলেননি। এবং করেনওনি। কখনও মেসেজ এসেছে, তিনি ভাল আছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর অফিস। এ ভাবেই চলছিল।

অক্টোবরে পুজোর ঠিক আগে উদয়ন হঠাৎই এক দিন হাজির হয় আকাঙ্ক্ষার বাড়িতে। শিবেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘ছেলেটা বলে, আকাঙ্ক্ষা আমেরিকায় খুব ভাল আছে। মেয়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের কথা জানা থাকায় ওর কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ট্রেন না থাকায় আমাদের বাড়িতেই রাত কাটায়। ওর ব্যবহারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি। এখন জানতে পারলাম, ওই-ই আমার মেয়ের খুনি!’’ তিনি জানান, আকাঙ্ক্ষা মেসেজে শুধুই নিজের কথা বলতেন। ‘‘যে মেয়ে সবার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলত না, ফোন করলে দাদু-দিদা, মামা-মামি সবার খোঁজ নিত, সেই মেয়ে কী করে এত পাল্টাল, খটকা জাগল। নভেম্বরে বাড়ি আসবে বলে জানালেও পরে আসব না বলে দেয়। সন্দেহ আরও বাড়ে।’’—বলে চলেন শিবেন্দ্রবাবু।

ডিসেম্বরে বাঁকুড়া সদর থানায় মেয়ের নিখোঁজ ডায়েরি করেন শিবেন্দ্রবাবু। পুলিশও আকাঙ্ক্ষার মোবাইলে বারবার ফোন করে। কিন্তু, সাড়া মেলেনি। এক দিন জেলা পুলিশের প্রাক্তন ডিএসপি বাপ্পাদিত্য ঘোষের মোবাইলে ওই নম্বর থেকেই মেসেজ আসে, ‘কেন বারবার ফোন করে বিরক্ত করছেন!’ বাপ্পাদিত্যবাবু নিজের পরিচয় জানান। তখন তাঁর পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হয়। সেটাও ওই নম্বরে পাঠান ডিএসপি। তার পরেও ওই নম্বর থেকে সাড়া মেলেনি। এ বার আকাঙ্ক্ষার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে, আমেরিকা নয়, দিল্লি থেকে সরাসরি ভোপালে গিয়েছিলেন আকাঙ্ক্ষা।

প্রথম থেকে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় ছিল বছর বত্রিশের উদয়ন। তাঁর ফেসবুক থেকে মোবাইল নম্বর জোগাড় করে টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে, ওই নম্বরটিও সাকেতনগরে রয়েছে। সিআই (বাঁকুড়া সদর) অমিতাভ কোনার এবং ঘটনার তদন্তকারী অফিসার কৌশিক হাজরার নেতৃত্বে ছ’জনের একটি টিম বৃহস্পতিবার সাকেতনগরে পৌঁছয় আকাঙ্ক্ষার দাদাকে নিয়ে। গোবিন্দনগর থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যায় উদয়নের বাড়িতে। পুলিশ সরাসরি জিজ্ঞেস করে, আকাঙ্ক্ষা কোথায়? উদয়ন জানায়, আমেরিকা। কিন্তু, জেরার মুখে ভেঙে পড়ে জানায়, তার শোওয়ার ঘরে ঠাকুরের বেদির তলায় চাপা রয়েছে আকাঙ্ক্ষার দেহ। শুনে পুলিশও থ!

বেদি ভাঙতেই উদ্ধার নরকঙ্কাল (বাঁ দিকে)। আকাঙ্ক্ষার দেহ চাপা বেদি (নীচে)। ধৃত উদয়ন দাস (উপরে)।

কয়েক ঘণ্টার মেহনতে ড্রিল মেশিনের সাহায্যে পুলিশ খোঁড়াখুঁড়ি করে ট্রাঙ্ক বের করে আনে। তার মধ্যে দেহ। ওটাই আকাঙ্ক্ষা, জানিয়ে দেয় উদয়ন! তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, উদয়নের বাড়ির ভিতরে ঢুকে তাঁরা দেখেন সমন্ত জিনিস অগোছালো। জানলা বন্ধ সেলোটেপ দিয়ে। আলো-বাতাস কার্যত ঢোকে না। খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে রয়েছে ঘর জুড়ে। উদয়নের পড়শিরা পুলিশকে জানান, ওই যুবক বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াত শহরে।

পুলিশের অনুমান, আকাঙ্ক্ষা স্বেচ্ছায় ওই যুবকের সঙ্গে ভোপালে থাকছিলেন। কোনও কারণে তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরে। তারই জেরে ‘প্রেমিকা’কে খুন করে উদয়ন। কিন্তু, কবে এই খুন হয়েছে, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের একাংশের সন্দেহ, জুলাই বা অগস্টের কোনও এক সময়ে খুন হন আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, ওই সময় অবধি বেঁচে থাকলেও ওই তরুণী কেন একবারও ফোন করেননি বাড়িতে? তা হলে কি আরও আগেই তাঁকে মারা হয়েছিল?

আবার পুলিশের অন্য একটি অংশ মনে করছে, আকাঙ্ক্ষা নিজেই চাননি ফোন করতে। তিনি যে ‘প্রেমিকের’ সঙ্গে ভোপালে আছেন, চাননি তা কোনও ভাবে ফাঁস হোক। সে জন্যই আমেরিকা চলে যাওয়ার গল্প ফেঁদেছিলেন ওই তরুণী।

কিন্তু, প্রেমের পরিণতি যে এমন হবে, সেটা আঁচ করতে পারেননি আকাঙ্ক্ষা। দক্ষিণ ভোপালের পুলিশ সুপার সিদ্ধার্থ বহুগুণা এ দিন জানান, উদয়নের নামে কোনও অপরাধমূলক কাজের রেকর্ড নেই। তাঁর মা বিদেশে থাকেন। বাবা মারা গিয়েছেন। ওই যুবক তেমন কিছু কাজ করেন না। মায়ের পাঠানো টাকায় তাঁর চলে। তিনি বলেন, ‘‘উদয়ন জেরায় দাবি করেছে, বচসার জেরে রাগের মাথায় সে খুন করেছে।’’

বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার জানান, মেঝে নিজেই খুঁড়েছিল উদয়ন। নিজেই ঢালাই করেছিল। এক রাজমিস্ত্রিকে ডেকেছিল বটে, তবে তাকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। সে শুধু বাইরে সিমেন্ট-বালি মিশিয়েছে। গোটা কাজটা ওই যুবক নিজের হাতে করেছে। পরে মেঝের উপরে অন্য মিস্ত্রিকে ডেকে মার্বেল বসিয়ে নেয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Concrete transit remand
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE