শিউরে ওঠার মতো হত্যাকাণ্ড। প্রতীকী ছবি।
শিউরে ওঠার মতো সব ঘটনা! নৃশংসতায় কে কাকে ছাপিয়ে যায়— হিসেব কষা যায় না। বৃহস্পতিবার দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে, এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ফ্ল্যাট থেকে সুটকেসবন্দি তরুণীর পচাগলা দেহ উদ্ধারের পর অতীতের আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ফিরে আসছে স্মৃতিতে।
প্রত্যেকটা ঘটনা একই প্রশ্ন তুলেছিল মানুষের মনে। এতটা নৃশংসও হতে পারে মানুষ? এ ভাবে খুন করে দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে কেউ? ভরে ফেলতে পারে সুটকেসে বা টিভির বাক্সে? এমন কাণ্ড ঘটানোর পরও, মানুষ ঠান্ডা মাথায় প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করতে পারে কী ভাবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে যেতে হবে মনস্তত্ত্ববিদদের কাছে। কিন্তু, তার আগে ফিরে দেখা যাক এমন কয়েকটি ঘটনা।
এই সব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলোতেই কিন্তু হত্যাকারীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কোনও ক্ষেত্রে নিহতের পরিচয় পর্যন্তও জানা যায়নি।
আরও পড়ুন: সুটকেসে তরুণীর দেহ, দুর্গাপুরে আটক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার
২০০৩ সাল: ডানকুনি লোকালে নুনমাখা দেহাংশ
ফেব্রুয়ারি মাস। শিয়ালদহ স্টেশনে ডানকুনি লোকালের কামরায় সাদা রঙের ব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল নাভি থেকে ঊরু পর্যন্ত কাটা নুনমাখা দেহাংশ। ঠিক আগের রাতে কল্যাণী স্টেশনে রেল লাইনের ধারে মিলেছিল আর একটি ব্যাগ। তাতে মিলেছিল একটি পুরুষের মাথা-সহ দেহের নানান কাটা অংশ। তদন্তে নেমে রেল পুলিশ দু’টি ব্যাগের দেহাংশ জোড়া দিয়ে দেখেছিল— সেটি একই পুরুষের। কিন্তু ওই দেহের মালিক কে সেটা জানতে পারেনি রেল পুলিশ। বিভিন্ন রেল স্টেশনে নিহতের ছবি এবং তার সঙ্গে পাওয়া জিনিসপত্রের ছবি পাঠিয়েছিল রেল পুলিশ। ছবি গিয়েছিল বিভিন্ন থানাতেও। খুন করার পর কার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তায় ভরে বিভিন্ন স্টেশনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেই রহস্যের কিনারাই করতে পারেনি পুলিশ। ফলে তদন্তের কাজ আর এগোয়নি।
২০০০ সাল: চেন্নাই মেলে মহিলার কাটা মাথা
ঠিক একই ভাবে ১৫ বছরেও রেল পুলিশ জানতে পারেনি ২০০০ সালে ডাউন চেন্নাই মেলে বস্তায় মুড়ে কোন মহিলার মাথা এবং দু’টি হাত রেখে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ওড়িশার বোলাঙ্গির স্টেশনে এক মহিলার ধড় এবং হায়দরাবাদের নামপল্লি স্টেশনে এক মহিলার দু’টি পা উদ্ধার হওয়ার পরে সব অংশ জোড়া দিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, মৃতদেহটি একই মহিলার। কিন্তু সেই মহিলা কে, তাঁকে কারা খুন করল তা জানতে না পারায় ওই ঘটনার তদন্তই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: ক্যানিংয়ে ‘আক্রান্ত আমরা’র উপর হামলা, মাথা ফাটল অম্বিকেশদের
২০০৩ সাল: টিভির বাক্সে দেহ
লালবাজার সূত্রের খবর, ওই বছর নভেম্বরে পারিবারিক গোলমালের জেরে মিটন দাস নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে তাঁরই পরিবারের দুই সদস্য। খুনের পর মিটনের দেহ দু’টুকরো করে অভিযুক্তরা। পরে একটি টিভির বাক্সে মাথা থেকে ঊরু পর্যন্ত দেহাংশ ভরে, ফেলে দেওয়া হয় বেলেঘাটা চাউল পট্টি রোডের ধারে একটি খালে। তদন্তে নেমে অবশ্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
২০০৮ সাল: শপিং ব্যাগে শিশু
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে উল্টোডাঙায় খালের কাছে একটি শপিং ব্যাগের মধ্যে উদ্ধার হয় এক বছরের শিশু ইন্দ্রজিৎ সাহার দেহ। খুনের পরে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটেছিল দুষ্কৃতীরা। এক দিন পরে ডানকুনি টোলপ্লাজার কাছে বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই শিশুর মা বুলা সাহার মৃতদেহ। চার্জশিটে পুলিশ জানায়, পারিবারিক বিবাদের জেরে ওই শিশুকে এবং তার মাকে খুন করেছিল পরিবারেরই দুই সদস্য।
২০০৯ সাল: টিনের বাক্সে মহিলা
বুলা সাহা কাণ্ডের ঠিক ছ’মাসের মাথায় নারকেলডাঙ্গা খালের পাশে রেল ব্রিজের নীচে একটি টিনের বাক্সের মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় ক্ষতবিক্ষত এক মহিলার দেহ। পরে জানা যায় ওই মহিলার নাম স্বপ্না চক্রবর্তী। টিনের বাক্সের সূত্র ধরেই ওই খুনের কিনারা করে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররা।
২০১১ সাল: বার কোডে সমাধান
কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন হোমিসাইড বিভাগে কাজ করা এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালে নিউ আলিপুরে। একটি টিভির বাক্সের ভিতর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় এক প্রতিবন্ধী মহিলার দেহ। এমন ভাবে মহিলার দেহের বিভিন্ন অশে ধারালো অংশ দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল যে মৃতদেহটি শনাক্ত করারই উপায় ছিল না। পরে ওই টিভি বাক্সের উপরে টিভি নির্মাতা সংস্থার ‘বার কোড’ দেখে মহিলাকে শনাক্ত করে কলকাতা পুলিশ। মহিলার এক আত্মীয়কে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দারা।
২০১৪ সাল: বেডিংয়ের ভিতরে কাটা দেহ
ওই বছর ২০ মে শিয়ালদহ স্টেশনের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে একটি ট্রলি ব্যাগ এবং বেডিং পড়ে থাকতে দেখেন রেল পুলিশকর্মীরা। পরে তা খুলে তাজ্জব হয়ে যান পুলিশকর্মীরা। বেডিংয়ের মধ্যে চাদরে মোড়া গলা থেকে কোমড়। আর ট্রলি ব্যাগের মধ্যে মহিলার মাথা, কাটা হাত-পা মেলে। পরে ওই ট্রলি ব্যাগের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে ওই মহিলার নাম জয়ন্তী দেব। ওই ঘটনায় মহিলার স্বামী-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছিল রেল পুলিশ। লেকটাউনের বাড়িতে খুন করার পর রাতের অন্ধকারে ফেলে যাওয়া হয় শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে।
(বাঁ দিক থেকে) সুচেতা চক্রবর্তী, সুচেতার মেয়ে দীপাঞ্জনা এবং ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ সরকার।
২০১৫ সাল: সুটকেসে মা-মেয়ের টুকরো করা দেহ
এই ঘটনাও স্তম্ভিত করে দিয়েছিল সবাইকে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ সরকার— প্রেমিকা আর তাঁর চার বছরের মেয়েকে খুন করেছিল প্রেমিকারই দুর্গাপুরের ফ্ল্যাটে। তার পর তাঁদের দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে টারটে সুটকেসে ভরে রাখে। শেওড়াফুলিতে নৌকায় উঠে মাঝগঙ্গায় ওই সুটকেসগুলি ফেলতে গিয়ে সে ধরা পড়ে যায়।
কিন্তু মানুষ এত নৃশংস হয় কী ভাবে?
এ ভাবে খুন করার মানসিক জোর ওই সব খুনিরা পায় কোথা থেকে? মনরোগ চিকিৎসক কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এমনিতেই কিছু মানুষ স্বভাবগত ভাবে অতি নৃশংস হয়। সেটাই তার মানসিক অবস্থা। এটাকে বলে অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। তবে, এক দিনে এটা তৈরি হয় না। একেবারে ছোটবেলা থেকেই মানে ৫-৬ বছর বয়স থেকেই এই তাদের ভিতর তৈরি হয়। ছোট ছোট নানা ঘটনা ঘটিয়ে এক দিন তারা এমন একটা বড় কিছু করে ফেলেন। এ জন্য তাদের কোনও অনুশোচনা বোধও কাজ করে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy