শিশুকন্যাকে শনাক্ত করার পরে। শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে শ্রুতিধর। সোমবার। ছবি: দীপঙ্কর দে।
মুখটা নেই।
মাথার পিছনের অংশে কার্যত খুলি বেরিয়ে এসেছে।
কনুই থেকে ডান হাত নেই। পা দু’টি ওড়না দিয়ে বাঁধা। পরনে ফ্রক।
রবিবার রাতে ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডে ঘাটের কাছ থেকে এই অবস্থায় ব্যাগে ভরা যে শিশুর দেহটি মিলেছিল, তা তাঁর মেয়ে দীপাঞ্জনারই বলে শনাক্ত করলেন শ্রুতিধর মুখোপাধ্যায়।
এ দিন শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালের মর্গে এসে মেয়ের দেহ দেখে ডুকরে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘‘লোকটা কি মানুষ! যে ভাবে মেয়ে ও স্ত্রীকে খুন করা হয়েছে, আর কী বলব!’’ কিন্তু ওই বিকৃত দেহটি যে দীপাঞ্জনারই, সে ব্যাপারে তিনি কী ভাবে নিশ্চিত হলেন? শ্রুতিধরবাবু বলেন, ‘‘আমার মেয়ে, আমি চিনব না! শরীরের গঠন দেখে চিনেছি। আমার মতোই শরীরের অনুপাতে পায়ের মাপ, আঙুল ছোট।’’
দুর্গাপুরের বিধাননগর আবাসনের বাসিন্দা সুচেতা চক্রবর্তীকে খুনের অভিযোগে ধৃত সেখানকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ সরকারকেও রবিবার রাতে মর্গে নিয়ে গিয়ে শিশুটির দেহ দেখান পুলিশ অফিসারেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, শিশুটির পা তিনিই বেঁধেছিলেন বলে মর্গে কবুল করেন সমরেশ। কিন্তু সেই সময়ে দীপাঞ্জনার মৃত্যু নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। এর আগে শেওড়াফুলির কাছে গঙ্গা থেকে সুচেতার দেহের নিম্নাংশ উদ্ধারের পরে দেখা গিয়েছিল, তাঁরও পা দু’টি নাইলনের দড়িতে বাঁধা।
শনিবার গ্রেফতারের পরে সমরেশ পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন, তিনি সুচেতাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। তাই গত শুক্রবার তার সামনেই সুচেতা দীপাঞ্জনাকে চৌবাচ্চার জলে চুবিয়ে মারেন। তার পরে নিজে আত্মঘাতী হন। পরে অবশ্য সুচেতাকে খুনের কথা কবুল করেন সমরেশ। কিন্তু একবারও দীপাঞ্জনার মৃত্যু নিয়ে তাঁর পুরনো বয়ানের বদল ঘটাননি সমরেশ।
কিন্তু শিশুটির দেহ যে অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে, তাতে কিছুটা ধন্দেই পড়েছেন তদন্তকারীরা। দেহটি প্লাস্টিকে মোড়া ছিল না। ব্যাগে ছিল না কোনও রক্তের দাগও। কিন্তু মাত্র দু’দিনে কী ভাবে চার বছরের একটি শিশুর দেহ এতটা বিকৃত হয়ে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তদন্তকারীরা। তদন্তকারীদের কেউ কেউ মনে করছেন, সমরেশই শিশুটির মুখ বিকৃত করে দিয়েছিলেন কোনও ভাবে। তার পরে ব্যাগে ঢোকানোর সুবিধার জন্য তার পা দু’টি বেঁধে দেন। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, গঙ্গায় কোনও ভাবে ব্যাগটির চেন খুলে যায়। বড় কোনও মাছ শিশুটির মুখ এবং দেহের অংশ খেয়ে ফেলে থাকতে পারে।
এ দিনই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির দেহের ময়না-তদন্ত হয়। যে হেতু সুচেতার মুণ্ড এখনও মেলেনি এবং দীপাঞ্জনার মুখও বোঝা যাচ্ছে না, সেই কারণে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পুলিশের কাছে ওই দু’টি দেহের ডিএনএ টেস্টের অনুরোধ জানিয়েছেন শ্রুতিধরবাবু। জেলা পুলিশ অফিসারদের দাবি, দু’টি দেহের ময়না-তদন্ত এবং ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এলে তদন্তের সুবিধা হবে।
বস্তুত, ওই দু’টি রিপোর্টের উপরেই এখন জোর দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। কেননা, এখনও সমরেশ তাঁদের নানা ভাবে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। রবিবার রাতে পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী-সহ জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারা সমরেশকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করেন। কিন্তু তাতেও সমরেশ খুব একটা ভাঙেননি বলে পুলিশ সূত্রে খবর। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, শুক্রবার তিনি একটি ট্রলি-ব্যাগ কিনেছিলেন দুর্গাপুর থেকে। কিন্তু কোন দোকান থেকে কত দামে কিনেছিলেন, সে সব প্রশ্নের উত্তর দেননি। তবে, দাবি করেছেন, তিনি একাই সুচেতা এবং দীপাঞ্জনার দেহ লোপাট করার কাজ করেছেন।
কিন্তু মৃতদেহ লোপাট করতে যে ভাবে গোটা ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সমরেশের একার পক্ষে কতটা সম্ভব, তা সোমবারেও বোধগম্য হয়নি দুঁদে পুলিশ অফিসারদের। তদন্তের স্বার্থে ফের দুর্গাপুরে সমরেশকে দুর্গাপুরে নিয়ে গিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণের কথাও ভাবছে পুলিশ। তবে তিন দিন কেটে গেলেও বেশ কয়েকটি বিষয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। দুর্গাপুর থেকে এত দূরে কেন দেহ দু’টি টেনে নিয়ে এলেন সমরেশ? দেহ দু’টি নিয়ে সুচেতার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সূর্য ওঠার আগেই। সে ক্ষেত্রে কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই তিনি দেহ কেন কোথাও ফেলে দিলেন না? সমরেশ এ ব্যাপারে এখনও কোনও তথ্য পুলিশকে দেননি। তদন্তকারী এক অফিসার বলেন, ‘‘অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি। ধৃতকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল তথ্য বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy