পাকা ঘরের বালাই নেই। ঠুনকো চালার নীচেই চলে পঠনপাঠন। ঝড়বৃষ্টি হলে হয়রানি চরমে ওঠে। কুলতলিতে ছবিটি তুলেছেন দিলীপ নস্কর।
রাজ্য জুড়ে অসংখ্য স্কুলে যথেষ্ট সংখ্যায় ক্লাসঘর নেই। আলাদা ঘর নেই প্রধান শিক্ষকের। এই নেই-নেই-এর মধ্যেই রাজ্য সরকার বলছে, মিড-ডে মিলের জন্য আলাদা খাওয়ার ঘর তৈরি করতে হবে!
স্কুলশিক্ষা দফতরের এ-হেন সিদ্ধান্তে আতান্তরে পড়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের কর্তৃপক্ষ। কেননা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৩০ জন পড়ুয়া-পিছু একটি ক্লাসরুম থাকার কথা। অথচ বিভিন্ন জেলায় প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বসিয়ে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরির টাকাই তো মিলছে না। ক্লাসঘরের টানাটানির সঙ্গে সঙ্গে অভাব শিক্ষকেরও। পঠনপাঠনের প্রাথমিক পরিকাঠামোর এই ঘাটতির ছবি বেআব্রু হয়ে গিয়েছে সর্বশিক্ষা মিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে।
সেই অবস্থার পরিবর্তন না-করেই দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য সরকার আলাদা ঘর তৈরি করতে উদ্যোগী হওয়ায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচনা শুরু হয়েছে শিক্ষাজগতে। সেই সমালোচনার পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে শিক্ষা দফতরের অনেকে আবার বলছেন, প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিল দেওয়াটা যে জরুরি, সেই বিষয়ে তো আর কোনও দ্বিমত নেই। সেই খাবারটুকু হেলাফেলা করে দেওয়া হবে কেন? তাই খাওয়ার ঘরের বন্দোবস্ত হচ্ছে।
তাই আপাতত সুন্দরবন, জঙ্গলমহল এবং চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকার জেলাগুলির স্কুলে পৃথক খাওয়ার ঘর করতে ১৩ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে স্কুলশিক্ষা দফতরের খবর। সুন্দরবন এলাকায় দুই ২৪ পরগনা; জঙ্গলমহলের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং চা-বাগান এলাকার আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার স্কুলগুলিতে খাওয়ার ঘর তৈরি করা হবে। বিশেষ করে জঙ্গলমহলের জন্য এই খাতে বরাদ্দ করা হচ্ছে মোটা টাকা।
ওই সব জেলা যে আর্থিক ভাবে অনেকটাই পিছিয়ে, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে শিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে মিড-ডে মিল অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু খাওয়ার ঘরের অভাবে মিড-ডে মিল দিতে অসুবিধা হয়। কখনও কোনও কৌটোয় খাবার দিতে হয়, কখনও বা শালপাতায়। কেউ কেউ খাবার বাড়ি নিয়ে যায়, অনেকে রাস্তার ধারে বসে খায়। এটা যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনই দৃষ্টিকটু। সেই জন্যই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় খাওয়ার ঘর তৈরির উপরে জোর দিতে বলেন। তার পরেই এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
‘‘রাস্তায় বসে খাবার খেতে হলে পড়ুয়ারা কি আর স্কুলে আসতে চাইবে? তাই খাওয়ার ঘর তৈরির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। স্কুলের অন্যান্য সমস্যার সুরাহা করতেও যথেষ্ট চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার,’’ বলছেন শিক্ষামন্ত্রী।
স্কুলে পঠনপাঠনের যথাযথ পরিকাঠামো তৈরি না-করে এমন সিদ্ধান্ত কেন, তা নিয়ে অবশ্য স্কুলশিক্ষা দফতরেরও অনেক কর্তার প্রশ্ন ও সংশয় আছে। তাঁরা সর্বশিক্ষা মিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টের উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, জেলার স্কুলগুলিতে ক্লাসরুমের আকাল ভয়াবহ। যেমন আলিপুরদুয়ারে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক মিলিয়ে মোট স্কুল ১৫০০। তার মধ্যে তিনশোর বেশি স্কুলে ঘাটতি আছে ক্লাসরুমের। বাঁকুড়ায় স্কুলের সংখ্যা ৪৪৯০। সেখানে পাঁচশোর বেশি স্কুলে যথেষ্ট ক্লাসরুম নেই। কোচবিহারে প্রায় ৯০০ স্কুলে পড়ুয়াদের বসানোর ঘর নেই। নেই প্রধান শিক্ষকের ঘরও। কম শিক্ষক নিয়েই চলছে বহু স্কুল।
শিক্ষার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ার আগে খাওয়ার ঘর তৈরির সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অনেক শিক্ষকও। বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘খাওয়ার ঘরের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যদি শিক্ষকের আকাল থাকে, সর্বোপরি যথেষ্ট ক্লাসঘরই যদি না-থাকে, তা হলে খাওয়ার ঘরের প্রয়োজন কী?’’ পঠনপাঠনের সমস্যা না-মিটিয়ে আনুষঙ্গিক কাজ করতে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকেই সরকার সরে যাচ্ছে বলে অনুযোগ বহু শিক্ষক সংগঠনের।
শ্রেণিঘরের মতো পরিকাঠামোর ঘাটতি যে মেটানো যাচ্ছে না, তার দায় কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন শিক্ষা দফতরের কিছু কর্তা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ক্লাসঘর তৈরি করতে হলে তা সর্বশিক্ষা মিশনের টাকাতেই করার কথা। কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে তা করা হয়। কিন্তু সর্বশিক্ষা খাতে অর্থ কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। তা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগী হবে বলে জানান এক শীর্ষ কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy