সিজিও কমপ্লেক্সে মুকুল রায়। শুক্রবার। ছবি: শৌভিক দে।
পাঁচ ঘণ্টা জেরার পরে আপাতত স্বস্তি! প্রথম দিন সিবিআইয়ের ঘেরাটোপ থেকে যখন বেরিয়ে এলেন মুকুল রায়, দৃশ্যতই তাঁকে অনেক চাপমুক্ত লাগছিল। আর তাতেই উল্টে আরও বেড়ে গেল তৃণমূলের কাঁপুনি!
সিবিআই দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব শেষে বেরিয়ে শুক্রবার বিকেলে ঠান্ডা মাথায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য, “আগেই বলেছিলাম, আমি এই তদন্তে (সারদা) সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমি চাই, সঠিক পথে তদন্ত হোক। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হোক। তার জন্য সিবিআই যদি আমাকে আবার ডাকে, আমি আবার যাব। যখন ডাকবে, তখনই যাব!” আপাতদৃষ্টিতে খুবই স্বাভাবিক মন্তব্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য সিবিআইকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে মুকুলের দল এর মধ্যেই বাজারে নেমেছে। তারা কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার আঞ্চলিক দফতরের সামনে ধর্নায় বসেছে, তদন্তের ব্যাপারে যাতে সুপ্রিম কোর্ট নজরদারি করে সে জন্য শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থও হয়েছে। সেই দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা যখন ‘প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে’র কথা বলেন, তার তাৎপর্য ভিন্ন হতে বাধ্য! শাসক দলের অন্দরে যে কারণে এ দিন থেকে জল্পনা আরও প্রবল হয়েছে যে, সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের মুখোমুখি হয়ে মুকুল আসলে কোন সত্য উদ্ঘাটন করে এলেন? তদন্তকে ‘সঠিক পথ’ দেখাতে কি শাসক দলে আরও উপরের দিকের সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে এলেন? দিনের শেষে তাই জেরার ধকল কাটিয়ে স্বয়ং মুকুল যতটা স্বস্তিতে, তাঁর দল ততটাই অস্বস্তিতে!
সারদা-কাণ্ডে এর আগে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র প্রথম দিনের জেরা-পর্বেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। আবার সৃঞ্জয় বসু, রজত মজুমদারেরা গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পরে। সেই অর্থে মুকুলের প্রথম দিন রেহাই পাওয়ার মধ্যে খুব আস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু তৃণমূলের আরও যারা এ যাবৎ সিবিআইয়ের কাছে ডাক পেয়েছেন, তাঁদের সকলের চেয়ে ধারে-ভারে ও রাজনৈতিক উচ্চতায় মুকুল অনেক এগিয়ে। সিজিও কমপ্লেক্সে যাওয়ার সময় এ দিন তাঁর চেহারায় যেটুকু উদ্বেগের চিহ্ন ছিল, বেরোনোর সময় সেটুকুও ছিল না! বরং, যে ভঙ্গিতে তিনি গুছিয়ে সত্য উদ্ঘাটন এবং সেই প্রক্রিয়ায় তাঁর সহযোগিতার কথা বলেছেন, এক বারের জন্যও চক্রান্তের তত্ত্ব মুখে আনেননি, তাতে তৃণমূলের অন্দরে আতঙ্ক এবং সন্দেহের বাতাবরণ কয়েক গুণ জোরালো হয়েছে। দিনভর একাধিক মন্ত্রী থেকে শাসক দলের বড়-মাঝারি নেতারা নিজেদের বৃত্তে খোঁজ নিয়েছেন, “রহস্যটা কী? মুকুল কাকে নিশানা করে এল? কোনও বড় মাথা কি?”
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মিলন মেলার উদ্বোধন। এখানেই নেত্রীর নির্দেশে ফিরহাদের
আবৃত্তি এবং তার পরেই মমতার হুঙ্কার। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
সিবিআই সূত্র কিন্তু দাবি করছে, তৃণমূল নেতৃত্বের এই অস্বস্তি এবং আশঙ্কা অমূলক নয়! সূত্রের খবর, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সিবিআইয়ের ঝোলায় উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য! তুলে এনেছেন দলের শীর্ষ স্তরের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীর নামও। যে সব তথ্য আগামী দিনে তদন্তের কাজে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রচুর সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। সিবিআই সূত্রের দাবি, ডেলো পাহাড়ের বৈঠক নিয়ে বহু তথ্য যেমন মুকুল দিয়েছেন, তেমনই এড়িয়ে যাননি আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তির প্রসঙ্গও। যে চুক্তির সময়ে রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিবিআই সূত্রের আরও দাবি, তৃণমূলের সঙ্গে সারদা তো বটেই, এমনকী অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার নিবিড় সম্পর্ক নিয়েও এ দিন সিবিআইয়ের ৬ জন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের সঙ্গে সবিস্তার আলোচনা করেছেন মুকুল। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
মুকুল নিজে অবশ্য সিবিআইয়ের জেরা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তদন্তকারীদের সঙ্গে একান্তে আমার কী কথা হল, সেটা প্রকাশ্যে বলার বিষয় নয়।”
তবে মুকুলের জেরা পর্ব নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, “ওঁকে ছেড়ে দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর ঘুম উড়ে যাচ্ছে! কী বলে এসেছেন, সেটা একটা ব্যাপার! ডেলোর বৈঠক, টাকা কোথায় গেল, আরও অনেক ব্যাপার আছে। সিবিআইকে মুকুল যদি সহযোগিতাই করে আসেন, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য দিন গোনার অপেক্ষা!” বস্তুত, পুরুলিয়া জেলা সিপিএমের সম্মেলনে গিয়ে এ দিন মুকুলের জেরা চলাকালীনই সূর্যবাবু প্রথমে বলেছিলেন, “উনি যদি বার হন, জানবেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে এসেছেন!” আর মুকুল বেরিয়ে আসার পরে তাঁর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী এখন না পারছেন গিলতে, না পারছেন ওগরাতে!”
বিরোধী নেতারা যে খুব ভুল বলছেন না, তার ইঙ্গিত এ দিন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সের বন্ধ ঘরে তাঁর এক সময়ের দক্ষিণহস্ত যখন সিবিআইয়ের প্রশ্নবাণ সামাল দিচ্ছেন, শহরের অন্য প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রী তখন উর্দু শায়েরিতে ভর করে ভয়কে জয় করার বার্তা শুনিয়েছেন! নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সরকারি অনুষ্ঠানে এ দিন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সংখ্যালঘু তরুণ-তরুণীদের সামনে তাঁর সদ্যপ্রকাশিত উর্দু শায়েরির বইয়ের পংক্তিকেই হাতিয়ার করেছেন তিনি। রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে ডেকে ‘ওই কোটেশনটা বল’ বলে তাঁর নিজের লেখা পড়তে হাঁক দিয়েছেন মমতা। ববিও গড়গড়িয়ে আবৃত্তি করেছেন, “তুমমে অউর মুঝমে তো ফরখ হ্যায় হি / কিঁউ কি তুম কবর সে ডরতে হো অউর কফন মেরা ইন্তেজার করতি হ্যায়”!
এ দিনের ঘটনাক্রমের নিরিখে শায়েরির এই পংক্তি নির্বাচন কারও কারও চোখে তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকেছে! কফন শব্দের অর্থ, মৃতের গায়ে দেওয়ার চাদর। মমতার উর্দু লেখার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘তোমার আমার মধ্যে ফারাক তো আছেই / তুমি কবরে যেতে ভয় পাও আর কফন আমার প্রতীক্ষা করে’। ববি পংক্তি দু’টো বলতেই তাঁর হাত থেকে মাইক কেড়ে মমতার হুঙ্কার, “আমায় ভয় দেখিয়ে চমকে-ধমকে লাভ নেই! মৃত্যু এক দিনই হয়, রোজ রোজ কেউ মরে না!” প্রশ্ন উঠেছে, মনে আতঙ্ক চেপে বসেছে বলেই কি ‘ভয় পাই না’ দেখাতে মুখ্যমন্ত্রীর এত মরিয়া চেষ্টা?
মুকুল আবার ঠিক বিপরীত প্রান্তে। কথাবার্তায়, হাবে-ভাবে ভয়ের চিহ্ন নেই। বরং, বারেবারেই তৃণমূলের সঙ্গে নিজের ফারাক দেখানোর চেষ্টা খুব স্পষ্ট। সারা দিনে তৃণমূল শব্দটা যেন তাঁর সঙ্গে ছিলই না! তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ‘সাধারণ মানুষ’ বলে উল্লেখ করে। কোথাও মা-মাটি-মানুষের সরকার, ‘সততার প্রতীক’ দলনেত্রী বা দল হিসেবে তৃণমূলের নামোল্লেখ নেই! মুকুলের বহু প্রতীক্ষিত জেরার পরে দলনেত্রী প্রবল উৎকণ্ঠায় থাকবেন, খুব স্বাভাবিক। তৃণমূল সূত্রের খবর, সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে মুকুল কিন্তু তৃণমূল নেত্রীকে ফোন করেননি। সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রীরই ফোন এসেছিল তাঁর কাছে। এই ঘটনাও অস্বাভাবিক ঠেকছে দলের অনেকের কাছে।
সারদা-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই মমতার সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বেড়েছে মমতার। মমতার আমলে আইআরটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তির কথা প্রকাশ্যে আসার পরে দলনেত্রীর পাশে দাঁড়ানোর বদলে মুকুল বলেছিলেন, “ওই ঘটনা আমার সময় ঘটেনি।” তার পরেই দলে মুকুলের প্রভাব খর্ব করে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে আনতে শুরু করেন মমতা। এমনকী, কয়েক দিন আগে দলীয় সভায় এ-ও বলেছেন, ‘একটা মুকুল গেলে লক্ষ মুকুল আসবে’। তৃণমূলের অনেকের মতে, মুকুল যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন, তা বোঝাতেই এমন মন্তব্য মমতার।
মুকুল-ঘনিষ্ঠরা দাবি করছেন, সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দলে নিজের দাপট বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। তেমনই এক নেতার কথায়, “মদন মিত্রের সময় দলনেত্রী পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুকুলদার সময় কিন্তু কেউ দাঁড়ায়নি। কিন্তু দাদা বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিজের জন্য তিনিই যথেষ্ট!” আর স্বয়ং মুকুল সন্ধ্যায় পরিষ্কার করে বলেছেন, “আমি চাই, গরিব মানুষ তাঁদের যে শেষ সম্বল অর্থলগ্নি সংস্থায় রেখে ঠকেছেন, তাঁরা যেন টাকা ফেরত পান। তাঁরা যেন বিচার পান। সত্য উদ্ঘাটনে সিবিআই যদি আমাকে আবার ডাকে, আমি আবার যাব!”
যা শুনে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলছেন, “এত দিনে মুকুল রায়ের এই উপলব্ধি হল! এ বার মুখ্যমন্ত্রীর উপলব্ধি কী?” মুকুলের স্বস্তি দেখে বিজেপি-তৃণমূল ‘আঁতাঁতে’র সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। একই আশঙ্কা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও।
বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্য পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মন্তব্য, “বলেছিলাম তো ভাগ মুকুল ভাগ! ২০১৫ শুরু হল দৌড়-ভাগ দিয়ে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, দৌড়-ভাগ একটু কমলো! তবে সত্যিই কমলো কি? সেটা সিবিআই বলতে পারবে!” অনেকের প্রশ্ন, সমঝোতা হয়েছে কি? সিদ্ধার্থনাথের জবাব, “কোনও সমঝোতা হয়নি।”
কয়েক দফায় এ দিন মুকুলের সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। মাঝে কিছু ক্ষণ একটি ঘরে বসিয়ে রাখা হয় তাঁকে। জিজ্ঞাসাবাদ-পর্বে প্রায় সব প্রশ্নেরই তিনি নিজের মতো উত্তর দিয়েছেন বলে। ছিলেন শান্ত, স্থির।
এর পরে মুকুলের ভবিষ্যৎ কী? সিবিআই সূত্রের খবর, কয়েক দিনের মধ্যে একাধিক বার জেরা করা হতে পারে তাঁকে। তদন্তকারীদের আশা, তাঁর কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাঁরা পেতে পারেন। এক আধিকারিকের কথায়, “তিনি সহযোগিতা করছেন না বলে মনে হলে তাঁকে গ্রেফতারও করা হতে পারে।”
সে অবশ্য ভবিষ্যতের কথা। আপাতত মুক্ত মুকুল এবং তাঁর সত্য উদঘাটনের দাবি আতঙ্কের গারদে ভরে দিয়েছে তৃণমূলকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy