Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
অবিশ্বাসের আতঙ্ক

তৃণমূলে ত্রাহি রব, মুকুলে সন্দিহান মমতাও

শুক্রবার সিবিআই দফতর থেকে মুকুল রায় হাসি মুখে বেরিয়ে আসার পর থেকেই আতঙ্কিত তৃণমূল। দলের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে জোর জল্পনা, সিবিআই গোয়েন্দাদের জেরার মুখে আর কাকে কাকে নিশানা করে এলেন তিনি। সেই আতঙ্ক যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও ছুঁয়েছে, তার ইঙ্গিত মিলল শনিবার কালীঘাটে দলের কোর কমিটির বৈঠকে। যেখানে মুকুলের সামনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “জানি না, মুকুলকে ওরা (সিবিআই) কী জিজ্ঞাসা করেছে? কিন্তু ওর মুখ দেখে বুঝেছি, ওকে ওরা চাপ দিচ্ছে।” একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “ওরা আমাকেও গ্রেফতার করতে পারে। জেলে যেতে আমরা ভয় পাই না। আমাকে জেলের ভয় দেখাবেন না।”

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫২
Share: Save:

শুক্রবার সিবিআই দফতর থেকে মুকুল রায় হাসি মুখে বেরিয়ে আসার পর থেকেই আতঙ্কিত তৃণমূল। দলের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে জোর জল্পনা, সিবিআই গোয়েন্দাদের জেরার মুখে আর কাকে কাকে নিশানা করে এলেন তিনি। সেই আতঙ্ক যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও ছুঁয়েছে, তার ইঙ্গিত মিলল শনিবার কালীঘাটে দলের কোর কমিটির বৈঠকে। যেখানে মুকুলের সামনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “জানি না, মুকুলকে ওরা (সিবিআই) কী জিজ্ঞাসা করেছে? কিন্তু ওর মুখ দেখে বুঝেছি, ওকে ওরা চাপ দিচ্ছে।” একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “ওরা আমাকেও গ্রেফতার করতে পারে। জেলে যেতে আমরা ভয় পাই না। আমাকে জেলের ভয় দেখাবেন না।”

দলীয় নেতাদের বক্তব্য, মুকুল সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়েছেন শুক্রবার দুপুর সাড়ে তিনটেয়। আর মমতা এ কথা বললেন শনিবার দুপুর দু’টোর পরে। মাঝের প্রায় ২৪ ঘণ্টায় সিবিআইয়ের জেরার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে দু’জনের মধ্যে যদি কোনও কথা না হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে বিচ্ছেদের আর বাকি নেই। অন্য দিকে, যদি কথা হয়ে থাকে তা হলে এটা স্পষ্ট যে, মুকুলের সেই বয়ান বিশ্বাস করছেন না দলনেত্রী। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ডেলোর বৈঠক সূত্রে মুকুল মমতার নাম করেছেন বলেই সিবিআই গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি। তৃণমূল নেতাদের একাংশের মতে, তিনিও গ্রেফতার হতে পারেন, মমতার এমন আশঙ্কার কারণ এটাই।

মুকুলের প্রতি অবিশ্বাসের আরও রসদ মিলেছে মমতার এ দিনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “মুকুল নাকি সিবিআই-কে অভিষেকের নাম বলে এসেছে, লোকে বলছে।” যা শুনে দলের এক নেতার সরস মন্তব্য, “আমাদের দল এখন কাঁঠাল চোরের মাথায় আঠা লেগেছে কি না, তা নিয়েই ব্যস্ত!”

মুকুল নিজে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু তাঁকে ঘিরে অবিশ্বাস ও আতঙ্কের বাতাবরণ যে তৃণমূলকে গ্রাস করেছে, তা কবুল করছেন নেতাদের অনেকেই। এবং সেই অবিশ্বাস থেকেই এ দিন সাংগঠনিক ক্ষেত্রে মুকুলের ডানা আরও ছেঁটেছেন মমতা। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এত দিন এই ধরনের বৈঠকে মমতার ঠিক পাশেই বসতেন মুকুল। কিন্তু এ দিন মমতার ডান দিকে ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বাঁ দিকে সুব্রত বক্সী। মুকুল বসেছিলেন পার্থবাবুর পাশে।

এখানেই শেষ নয়। এত দিন দিল্লিতে সাংসদদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করতেন মুকুল একাই। এ দিন দলের রাজ্যসভার সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েনকে সেই কাজ করতে বলা হয়েছে। সঙ্গে থাকবেন সৌগত রায় ও কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, ডেরেককে পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। মুকুলের পাশাপাশি তাঁকেও সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা যা-ই হোক, এর মধ্যে দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মুকুলের প্রাধান্য যে খর্ব করা হল, তাতে সন্দেহ নেই।

দলে এত দিন মুকুলের যে সাংগঠনিক দায়িত্বভার থাকত, তা-ও যে আর রাখা হবে না, সেটাও এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে মমতা বলেছেন, মুকুলকে এখন ঘন ঘন দিল্লি-কলকাতা করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে সংগঠনের কাজ তিনিই দেখবেন। কাল সোমবারই মুকুলের দিল্লি যাওয়ার কথা।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

দলের বিরুদ্ধে ‘কুৎসার জবাব’ দিতে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করার জন্য একটি কমিটি এ দিন গড়েছেন মমতা। সেই কমিটিতেও মুকুলের স্থান হয়নি। তবে কলকাতা-সহ রাজ্যের প্রায় ৯০টি পুরসভার আসন্ন ভোটের জন্য গড়া কমিটিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন তিনি।

তৃণমূল সূত্রে খবর, মুকুলের ‘পরিবর্ত’ হিসেবে এ দিনের বৈঠকে তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, “শুভেন্দুর উপর বিজেপি চাপ দিচ্ছে। বলছে হয় জেলে যাও, নয় দলে এসো। শুভেন্দু তোমাকে বলছি, জেলে যেতে ভয় পাবে না।... তুমি দলের সাধারণ সম্পাদক। এখন থেকে সপ্তাহে দু’দিন তৃণমূল ভবনে বসবে। আরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।”

নেত্রীর কথা শুনে বৈঠকে পিছন দিকে বসে থাকা শুভেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি দলের অনুগত সৈনিক। দলের বাইরে আমার কোনও অস্তিত্ব নেই।” অথচ সাম্প্রতিক অতীতেই এই শুভেন্দুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মমতার। তাঁকে যুব তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে বসানো হয় অভিষেককে। তার পরেই অতীতের তিক্ততা ভুলে মুকুলের কাছাকাছি আসেন শুভেন্দু। এ দিন বৈঠকে অভিষেকের মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে শুভেন্দুর কথা বলার পরে তাঁকে নিজের গাড়িতে নবান্নেও নিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে দু’জনের একান্তে আলোচনা হয়। ১৪তলার বাগানে দু’জনে কিছু ক্ষণ পায়চারিও করেন।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ দিন রাতেই নিজাম প্যালেসে মুকুলের সঙ্গে দেখা করতে যান শুভেন্দু। রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে শুভেন্দু অবশ্য বলেন, “এ নিয়েও জল্পনা! এটা নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ। মুকুলদা আমার নেতা, আমি দেখা করতে আসব না?” তৃণমূলের কেউ কেউ বলছেন, বাড়তি গুরুত্ব পেয়েও তাঁর অবস্থান যে পাল্টায়নি, কালীঘাটকে এই বার্তা দিতেই নিজাম প্যালেস গিয়েছিলেন শুভেন্দু। দলের অন্য অংশের মতে, তাঁকে মুকুলের কাছে পাঠিয়েছিলেন মমতা নিজেই। এটা বোঝাতে যে, ‘ও (মুকুল) যেন সব ছেড়েছুড়ে না দেয়’!

তৃণমূলের ওই নেতাদের বক্তব্য, কোণঠাসা মুকুল যে তাঁর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন, এই আশঙ্কা পাক খাচ্ছে মমতার মনে। সে জন্যই শুক্রবার নেতাজি ইন্ডোরে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে নিজের লেখা উর্দু শায়েরি ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে দিয়ে পড়িয়ে ভয়কে জয় করার কথা বলেছিলেন। আর এ দিন, নিজের গ্রেফতারির সম্ভাবনার প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, “জেলে যাব, তবু মাথা নত করব না। সিপিএম-কে যখন হটিয়েছি, তার তুলনায় বিজেপি কিছুই নয়।”

দলীয় নেতৃত্বের একাংশের ধারণা, আক্রমণই রক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায় ধরে সারদা-কাণ্ডে দলকে আন্দোলনমুখী করতে চাইছেন মমতা। মুকুল অবশ্য এ দিন ফের বলেছেন, “আন্দোলনের পাশাপাশি আইনের পথে লড়াই করতে হবে। আবার তদন্তের জন্য সিবিআই ডাকলে যেতেও হবে। সহযোগিতাও করতে হবে।” দলের এক প্রবীণ মন্ত্রীও এ দিন বৈঠকের পরে স্বীকার করেন, “মদন মিত্রকে নিয়ে যে ভাবে দল পথে নেমেছে, তা ঠিক পথ নয়। মুকুল কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ঠিক পথই ধরেছেন।”

মমতার এই আক্রমণাত্মক অবস্থানকে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরাও। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, জেলে যেতে পারেন বলে মমতা যা বলেছেন, তার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। তাঁর কথায়, “উনি (মমতা) বুঝতে পারছেন, গরিব মানুষের টাকা লুঠ করার দায়ে দলের অনেকের মতো ওঁকেও জেলে যেতে হবে।” বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মন্তব্য, “তিন এম-এর মধ্যে একটি উইকেট পড়ে গিয়েছে। দু’নম্বর এম, যিনি মমতার ‘রাইট হ্যান্ড’ ছিলেন, সিবিআই অফিস থেকে বেরিয়ে হাসলেন। এক জন এম এখনও বাইরে আছেন।” তাঁরই দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, সারদা মামলায় মুকুল রায় রাজসাক্ষী হবেন। আর তখন ‘উপরে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না’।

অন্য বিষয়গুলি:

sarada mukul trinamul mamata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE