কালীঘাটের বাড়ি থেকে দলীয় বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই সে দিন পর্যন্ত তিনি বলে এসেছেন, দরজা খোলাই আছে। তাঁর দলে যাঁদের পোষাচ্ছে না, তাঁরা বেরিয়ে যেতে পারেন! শনিবারের বারবেলায় সেই কালীঘাটে বসেই তাঁর সতীর্থদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, দলে সকলে সব ব্যাপারে একমত না-ই হতে পারেন। তার জন্য দলে খোলাখুলি আলোচনা করাই ভাল! শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কাউকে শাস্তি তো দূরস্থান, বিদ্রোহীদের বেঁধে রাখতে একেবারে আবেদনের পথে চলে গেলেন মমতা!
দলে বা সরকারে ভিন্ন মত শুনতে তিনি খুব পছন্দ করেন, এমন অভিযোগ তৃণমূল নেত্রীর নামে কেউ কোনও দিন করতে পারেনি! সেই মমতাকে কড়া হুঁশিয়ারির পথ থেকে সরে এসে আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর আবেদন জানাতে শুনে তৃণমূল নেতারাই তাজ্জব! তা হলে কি দলনেত্রী বুঝতে পারছেন, দলের মধ্যে কণ্ঠরোধ করে রেখে বিদ্রোহ আর আটকানো যাবে না? তিনি কি আশঙ্কা করছেন, শাস্তির পথে গেলে শিথিল সংগঠন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে? মুকুল রায়ের মতো দক্ষ সংগঠকেরা বেসুরো গাইতে শুরু করায় এ বার ভাঙনের আতঙ্ক আরও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল বলেই এমন মানিয়ে চলার চেষ্টা? কালীঘাট-ফেরত দলের এক সাংসদের কথায়, “দিদিকে দেখে মনে হচ্ছে, চাপে আছেন! দলের কারও কিছু বলার আছে কি না, আজই জানতে চাইছিলেন! একটা টোল ফ্রি নম্বর দিয়ে বললেন, এখানে এসএমএস পাঠালে আমরা যোগাযোগ করে নেব। এমন তো কখনও করেন না!”
তৃণমূল সূত্র বলছে, সময়টাই এখন গোলমেলে। সারদায় সিবিআই এবং অন্য দিকে বিজেপি-র সাঁড়াশি চাপে শাসক দলের সর্বময় নেত্রী হাসফাঁস করছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, দীনেশ ত্রিবেদী, স্বপন ঘোষ, সব্যসাচী দত্তের মতো একের পর নেতা তোপ দাগছেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর বিজেপি-তে চলে গিয়েছেন। আরও একাধিক সাংসদ ও বিধায়ক গেরুয়া পথে পা বাড়িয়ে আছেন বলে দিবারাত্র জল্পনা চলছে। এই অবস্থায় মমতা বুঝেছেন, যার যা করার আছে, করে নিন এই বেপরোয়া মনোভাবে আর বোধহয় ভবি ভুলবে না! বরং, তাতে বিদ্রোহের প্রবণতা আরও বাড়বে। সংগঠনের রাশ আলগা হয়ে আসছে বলেই এখন সুর নরম করে আলোচনার আবেদন শোনা যাচ্ছে তাঁর গলায়। শাসক দলের এক তরুণ নেতার কথায়, “দলনেত্রী এ দিনের বৈঠকেও বলেছেন, দলের মধ্যে থেকে দলের ক্ষতি না করাই ভাল। কিছু বলার থাকলে দলের মধ্যে এসে বলুন। কথাটা ঠিক এই ভাবে উনি আগে বলেননি। আগে শুধু বলতেন, দরজা খোলাই আছে!”
এক দিকে যেমন আলগা সংগঠনে আরও ভাঙন ধরার আশঙ্কায় শাস্তিবিধানের পথে যাননি মমতা, উল্টো দিকে ‘যুবরাজে’র উত্থান-পর্বে সিলমোহর দেওয়া কিন্তু অব্যাহত রেখেছেন! পরিস্থিতি যতই শোচনীয় হোক, সংগঠনের কর্তৃত্ব যে তিনি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই তুলে দিতে চান, তা বোঝাতে এ দিনও কসুর করেননি মমতা। দলের রাজ্য নির্বাচন কমিটিতে নিয়ে এসেছেন অভিষেককে। ভারসাম্য রাখতে সঙ্গে অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীরও! বৈঠকের পরে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার সাংসদদের হয়রানির প্রতিবাদ জানাতে তৃণমূলের সংসদীয় দল উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যানের কাছে যাবে। এই দৌত্যের দেখভাল করবেন দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। সংসদীয় দলে সমন্বয়ের দায়িত্ব এখন ডেরেকেরই কাঁধে। এবং ডেরেকের সহযোগী হবেন লোকসভায় তৃণমূলের সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়। যে সিদ্ধান্তকে দলের অন্দরে অভিষেক-শিবিরের গুরুত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সরকারি ব্যাখ্যা, লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ (বৈঠকের পরে এ দিনই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন শুভেন্দু) এবং রাজ্যসভার নেতা মুকুল অন্যত্র ‘ব্যস্ত’। তাই কাজ সামলাবেন ডেরেক-সৌগত-অভিষেকরা। কারণ যা-ই হোক, যুবরাজের ছায়া যে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে, সেই সম্পর্কে নিঃসংশয় তৃণমূল শিবির। আবার এ দিনই কলকাতা-সহ বিভিন্ন পুরসভার ভোটের জন্য দলের আলাদা কমিটি তৈরি হয়েছে। তাতে অবশ্য মুকুলকেও রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও যে অভিষেকের মতামত গুরুত্ব পাবে, ধরেই রেখেছেন তৃণমূলের নেতারা।
এবং এখানেই ভয় দলের একাংশের! তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “দলের বর্ষীয়ান নেতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন, এই আশঙ্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনের নৈশভোজে আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও যুবরাজকে আটকে দেওয়া হল। আবার তাঁকেই তুলে ধরার চেষ্টা অব্যাহত! আসলে দলনেত্রী মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন, আগামী দিনে কাদের হাত দিয়ে তিনি দলটা চালাবেন!” দলের সাংসদ-বিধায়কদের একাংশের আশঙ্কা, যুবরাজকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জারি থাকলে শত আবেদন-নিবেদন বা টোল ফ্রি নম্বরেও বিদ্রোহের সুর দমানো যাবে না!
বৈঠক শেষে মুকুল রায়।
দুর্বলদের নিয়ে দল চলবে না, এ দিনের বৈঠকে এই কথাও বলেছেন মমতা। কঠিন লড়াই লড়তে লাগবে সবল লোক। কারা কারা ‘দুর্বল’, হাত তুলতে বলা হয়েছিল তাঁদের। বলাই বাহুল্য, হাত তুলে দুর্বলতার প্রমাণ দিতে কেউ চাননি! কিন্তু বিদ্রোহীদের কাউকে ন্যূনতম শাস্তিও না দিতে পেরে দলনেত্রী নিজের দুর্বলতাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন বলে শাসক দলের একাংশের অভিমত।
কয়েক দিন আগে তৃণমূল নেত্রীকে ‘একনায়কতন্ত্রী রাজা’ বলে তোপ দেগেছিলেন রাজ্যসভার বর্ষীয়ান সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভার সাংসদ দীনেশও প্রকাশ্যে মমতার সমালোচনা করেছেন। যাদবপুর-কাণ্ডে দলীয় লাইনের বিপরীতে হেঁটে রোষের মুখে পড়েছিলেন সাধন পাণ্ডে। সারদা ও সিবিআই নিয়ে মুকুলের সুরেই দলের ভিন্ন লাইনে হেঁটেছেন বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। আর এক বিধায়ক স্বপন দলনেত্রীকে চিঠি দিয়ে দলে দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বিচার না পেলে অনন্যোপায় হয়ে তাঁকে ‘অন্য সিদ্ধান্ত’ নিতে হবে। স্বপনবাবু না এলেও দেবব্রত,দীনেশ, সব্যসাচীরা এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা ছিল, প্রকাশ্যে বিদ্রোহের দায়ে সব্যসাচীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দিতে পারেন মমতা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উল্টো পথে হেঁটে অন্য নেতাদের সঙ্গে বনগাঁয় উপনির্বাচনের প্রচারের জন্য সাধন পাণ্ডে, দীনেশ, সব্যসাচীদেরও দায়িত্ব দিয়ে বসেছেন তিনি!
তৃণমূল নেত্রীর এ দিনের আবেদনের সুরেও অবশ্য যথেষ্ট সংশয়ী দলের একাংশ। এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় তো দলে চিঠি দিয়েই দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন। স্বপনবাবুও লিখিত ভাবে অভিযোগ করেছেন। কোনও কাজ হয়েছে? এখন কি তাঁরা টোল ফ্রি নম্বরে এসএমএস করার জন্য বসে থাকবেন?” দলেরই আর এক নেতার মন্তব্য, “চাপে পড়ে মানিয়ে চলার একটা চেষ্টা হচ্ছে।”
দলীয় সূত্রেই বলা হচ্ছে, ভাঙনের আশঙ্কাই সম্ভবত হাত বেঁধে ফেলেছে তৃণমূল নেত্রীর! বিরোধীরাও খোঁচা দিচ্ছেন, ভাঙনের ভয় পেয়ে এখন উল্টো গাইছেন মমতা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলেছেন, “দু’বছর ধরেই কথাটা বলে আসছি, দল ভাঙার জন্য উনি (মমতা) একাই যথেষ্ট! এখান থেকে, সেখান থেকে নিয়ে দলে জুড়েছেন। কুইক ফিক্স দিয়ে কি দল আটকানো যায়?” আর কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, “দল ভাঙানোর খেলায় উনিই তো ওস্তাদ ছিলেন। এখন নিজের খেলায় নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছেন!”
ভয়ের চোটে এখন জয় গণতন্ত্র!
ছবি: প্রদীপ আদক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy