Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

জ্বর বলে দুপুরে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন

সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন তিনি। মহিলাদের সঙ্গে একটু বেশি কথা বলেন, লক্ষ করেছিলেন সহকর্মীরা। কিন্তু সমরেশ সরকার যে এমন কাজে যুক্ত থাকতে পারেন, তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না দুর্গাপুরের মামরা বাজারের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী-আধিকারিকদের। বৃহস্পতিবার জ্বর হয়েছে জানিয়ে ব্যাঙ্কে আসেননি অন্যতম ম্যানেজার সমরেশবাবু। শুক্রবার এসেছিলেন, কিন্তু দুপুর ১২টা নাগাদ জ্বর আরও বেড়েছে জানিয়ে বেরিয়ে যান।

সুচেতা চক্রবর্তীর আবাসনের সামনে প্রতিবেশীদের জটলা। নিজস্ব চিত্র।

সুচেতা চক্রবর্তীর আবাসনের সামনে প্রতিবেশীদের জটলা। নিজস্ব চিত্র।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০২:৩৯
Share: Save:

সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন তিনি। মহিলাদের সঙ্গে একটু বেশি কথা বলেন, লক্ষ করেছিলেন সহকর্মীরা। কিন্তু সমরেশ সরকার যে এমন কাজে যুক্ত থাকতে পারেন, তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না দুর্গাপুরের মামরা বাজারের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী-আধিকারিকদের।
বৃহস্পতিবার জ্বর হয়েছে জানিয়ে ব্যাঙ্কে আসেননি অন্যতম ম্যানেজার সমরেশবাবু। শুক্রবার এসেছিলেন, কিন্তু দুপুর ১২টা নাগাদ জ্বর আরও বেড়েছে জানিয়ে বেরিয়ে যান। শনিবার সকালে হুগলির শেওড়াফুলিতে মাঝগঙ্গায় ভুটভুটি থেকে চারটি ব্যাগ ফেলে দিতে দেখে তাঁকে আটকান সহযাত্রীরা। একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হলে তা থেকে মহিলার দেহাংশ মেলে। গ্রেফতার করা হয় সমরেশবাবুকে। পুলিশ জেরা করে জেনেছে, দুর্গাপুরের বিধাননগরের বাসিন্দা সুচেতা চক্রবর্তী ও তাঁর বছর পাঁচেকের মেয়ে দীপাঞ্জনার দেহ ছিল ওই ব্যাগগুলিতে। সুচেতাদেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন ওই ব্যাঙ্ক আধিকারিক।
বছর তেত্রিশের সুচেতাদেবী থাকতেন বিধাননগরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সামনের দিকে পুরনো সরকারি আবাসনের একতলায়। তাঁর বাবা সুশীল চক্রবর্তী এমএএমসি কারখানার কর্মী ছিলেন। ২০০৭-এর ডিসেম্বরে সুচেতাদেবীর বিয়ে হয় বসিরহাটের এক শিক্ষকের সঙ্গে। ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে স্বামীর কাছ থেকে দুর্গাপুরে চলে আসেন তিনি। ২০০৯-এর জুনে মেয়ে দীপাঞ্জনার জন্ম হয়। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সুচেতাদেবীর সম্পর্কের টানাপড়েন চলতে থাকে। মাঝে এক বার মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে কল্যাণেশ্বরী মন্দির, মাইথনও ঘুরে এলেও বসিরহাটে আর ফেরেননি সুচেতাদেবী। বাবা মারা যাওয়ার পরে শুধু মেয়েকে নিয়ে বিধাননগরের আবাসনেই থাকছিলেন তিনি। গত ডিসেম্বরে শেষ বার দুর্গাপুরে দেখা করতে আসেন তাঁর স্বামী। কিন্তু দেখা পাননি। ঘর বন্ধ ছিল।

সমরেশবাবু ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন প্রায় ২২ বছর। দুর্গাপুরে রয়েছেন বছর তিনেক। ব্যাঙ্ক লাগোয়া আবাসনের দোতলায় একাই থাকেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে থাকেন টিটাগড়ের বাড়িতে। সুচেতাদেবী ব্যাঙ্কের মামরা বাজার শাখার গ্রাহক ছিলেন। কর্মীরা জানান, তিনি ব্যাঙ্কে আসতেন মাঝে-মধ্যেই। এখানে তাঁর লকারও আছে। দিন চার-পাঁচ আগে মেয়ে দীপাঞ্জনাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সে দিন ব্যাঙ্কের কর্মীদের কেউ-কেউ সমরেশবাবুকে তাঁর সঙ্গে হেসে কথা বলতে, দীপাঞ্জনাকে চকলেট দিতেও দেখেছেন। তবে সুচেতাদেবীর সঙ্গে যে তাঁর কী সম্পর্ক ছিল, তা তাঁরা জানতেন বলে সহকর্মীদের দাবি। ব্যাঙ্কের জনা কয়েক কর্মী জানান, সমরেশবাবুকে আর এক মহিলার সঙ্গে মাঝে-মাঝে দেখা গিয়েছে। সমরেশবাবু তাঁকে আত্মীয়া হিসেবে পরিচয় দিতেন।

আবাসনের একতলায় সুচেতাদেবীর পাশেই থাকতেন বসুমতী খাটুয়া। তিনি জানান, সুচেতাদেবী বাইরে গেলে মেয়েকে তাঁর কাছে রেখে যেতেন। এমনকী, স্কুল থেকে ফেরার সময়েও অনেক দিন দীপাঞ্জনা আগে তাঁদের বাড়িতে ঢুঁ মেরে যেত। বসুমতীদেবী জানান, মাঝে-মাঝে সুচেতাদেবী মেয়েকে নিয়ে দু’তিন দিনের জন্য কোথাও যেতেন। তবে ঘরে আলো-পাখা জ্বলত। শুক্রবার বিকেল থেকে বাড়ি তালাবন্ধ। শনিবার বন্ধ ঘরের বাইরে থেকে বোঝা গিয়েছে, ভিতরে পাখা চলছে।

প্রতিবেশী পিনাকী মিত্র জানিয়েছেন, সুচেতা গানবাজনা ভালবাসতেন। পয়লা বৈশাখ-সহ পাড়ার নানা অনুষ্ঠানে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন। এমনকী, গত বছর পয়লা বৈশাখে তাঁর স্বামীও প্রভাতফেরিতে যোগ দিয়েছিলেন। সুচেতাদেবীর তিন বছরের পরিচারিকা বন্দনা বাউরি জানান, মাঝে-মাঝে কয়েক দিনের জন্য তাঁকে কাজে আসতে বারণ করে দেওয়া হত। শুক্রবার সকাল ১০টা নাগাদ তিনি কাজে গিয়ে দেখেন, মা-মেয়ে ঘুমোচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই বাড়ির বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কাজ করেন জয়দেব দাস। তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনও তেমন সন্দেহজনক কিছু বুঝিনি। আজ খবর শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি।’’

আবাসনে ঢোকার প্রধান দরজায় তালা। প্রতিবেশীদের দাবি, সবার চোখ এড়িয়ে এখান থেকে চারটি বড় ব্যাগ বের করে নিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে বাইরের দিকের কাঠের দরজায় তালা নেই। লোহার গ্রিলে ভিতরের দিকে তালা ঝুলছে। সে তালা বাইরে থেকেও লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেই দরজার বাইরে কোনও কিছু টেনে বের করার মতো অস্পষ্ট দাগ রয়েছে। তবে তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা প্রমাণসাপেক্ষ। নিউটাউনশিপ থানার পুলিশ বিকেলে সেখানে যায়। তবে কেউ ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেননি। বিকেলে খবর জানাজানি হওয়ার পরে ভিড় জমে যায় আবাসনের সামনে। অনেককে আলোচনা করতে শোনা যায়, সুচেতাদেবীর কাছে মধ্যবয়স্ক, শ্যামবর্ণ এক ব্যক্তিকে আসতে দেখা যেত। তিনিই সমরেশ সরকার বলে অনুমান প্রতিবেশীদের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE