আরজি কর-কাণ্ডে দোষী সঞ্জয় রায়। তাঁকে আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তি দিয়েছে শিয়ালদহ আদালত। —ফাইল চিত্র।
আরজি কর-কাণ্ডে দোষী কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে নিজের বক্তব্য জানানোর জন্য তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছিল শিয়ালদহ আদালত। মোট ১০৪টি প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রশ্নেই উত্তর মেলেনি। বিচারক অনির্বাণ দাসের নির্দেশনামা অনুসারে, ৫৬টি প্রশ্নে সঞ্জয়ের জবাব এসেছে, ‘বলতে পারব না’।
সঞ্জয় কী কী বলেছেন, কোন কোন প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে নির্দেশনামায়। ৯ অগস্ট সকাল ১০টা নাগাদ আরজি করের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ফোন যায় এএসআই সমর পালের কাছে। সেই ফোন পেয়ে তিনি সেমিনার হলে গিয়ে মহিলার দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনও উত্তর মেলেনি সঞ্জয়ের থেকে। সে দিনই রাতে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখার সময় আরজি করেই কর্তব্যরত এক সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়কে শনাক্ত করেন। তা নিয়েও কিছু বলতে চাননি আরজি কর-কাণ্ডের দোষী।
তবে তিনি যে আরজি করে গিয়েছিলেন, সে কথা মেনে নিয়েছেন সঞ্জয়। তাঁর দাবি পুলিশের বিভিন্ন শাখা থেকে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখভালের জন্য তিনি হাসপাতালে যেতেন। সেই সূত্রেই আরজি করে গিয়েছিলেন। আরজি কর থেকে বেরিয়ে তিনি সিগারেটও টানেন বলে জানান আদালতে। গ্রেফতারের সময়ে সঞ্জয়ের শরীরে কিছু চোটও ছিল। তদন্তে উঠে এসেছে সেই চোট কোনও নখের থেকে হতে পারে। সিবিআই তদন্ত চলাকালীন একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তাঁদেরও সন্দেহ, নির্যাতিতা বাধা দেওয়ার কারণে সঞ্জয়ের শরীরে চোট লেগে থাকতে পারে। তবে মেডিক্যাল বোর্ডের ওই তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন সঞ্জয়। সিভিকের দাবি, তিনি সালুয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই ওই চোট লাগে।
পুলিশ প্রথমে সঞ্জয়কে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সন্তুষ্ট হওয়ার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অ্যারেস্ট মেমোতে দোষীর সইও রয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, সইয়ের কথা স্বীকার করে নেন সঞ্জয়। দোষী সিভিকের দাবি, তিনি দোষ কবুল করতে চাইছিলেন না। সেই কারণে তাঁকে মারধর করে দোষ কবুল করানো হয়েছে।
নির্দেশনামা অনুসারে, সঞ্জয় দাবি করেন, ৯ অগস্ট রাতে আরজি কর থেকে তাঁকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র জমা দিতে বলা হয়। তিনি রাজি না-হওয়ায় ধমক দেন আধিকারিকেরা। এর পরে তিনি মোবাইল, টাকার ব্যাগ এবং একটি মালা (কোনও দেবীর মালা) জমা দেন। সেই রাতে তাঁকে লক আপে রাখার বদলে অন্য একটি ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। সেখানে পুলিশ তাঁকে মারধর করে বলেও আদালতে দাবি করেন সঞ্জয়। সঞ্জয়ের দাবি, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের ঘরেও নিয়ে যাওয়া হয়। তিনিও তাঁকে দোষ কবুল করার জন্য বলেছিলেন।
পুলিশ ব্যারাকের যে ঘরে সঞ্জয় থাকতেন সেখানে তল্লাশি চালিয়েও পুলিশ বেশ কিছু জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল। ওই বাজেয়াপ্তের ঘটনাটি সাজানো হয়েছিল বলে দাবি করেন দোষী সিভিক। তাঁর দাবি, লালবাজারেই তাঁর থেকে জামাকাপড় নিয়ে নেয় পুলিশ। সেটিই পরে দেখানো হয়। বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্রের তালিকায় ধৃতের সই রয়েছে। সেটির ভিডিয়োও করা হয়েছে। সইটি নিজের বলে স্বীকার করলেও, ধৃতের দাবি ভিডিয়োটি পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছিল।
কলকাতা পুলিশের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার সেমিনার হলে গিয়ে নির্যাতিতার মুখে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। তাঁর ঠোঁটে এবং চোখে রক্ত ছিল। একটি চশমা পড়েছিল সেখানে, যার একটি কাচ ছিল না। সেখান থেকে একটি ব্লুটুথ ইয়ারফোনও পাওয়া গিয়েছিল। পরে দেখা যায় বাজেয়াপ্ত হওয়া মোবাইলের সঙ্গে ওই ব্লুটুথ ইয়ারফোনটি সংযুক্ত ছিল। তা নিয়েও কোনও মন্তব্য করতে চাননি দোষী সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়। পরে দাবি করেন, ওই ব্লুটুথ ইয়ারফোনের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগই নেই। নির্যাতিতার দেহ সরানোর পরে দেহের নীচ থেকে চশমার কাচটি উদ্ধার হয়েছিল। ওই চশমা নিয়েও বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয় সঞ্জয়কে। তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনও উত্তর মেলেনি।
চার জন চিকিৎসক নির্যাতিতার সঙ্গে ৯ অগস্টের শুরুর রাতে সেমিনার হলে নৈশভোজ করেন। রাত ১টা ১৫মিনিট নাগাদ তাঁদের নৈশভোজ শেষ হয়। বয়ান সংগ্রহের সময়ে উঠে এসেছে রাত ২টো ১৫ মিনিট নাগাদ ওই চার জনের মধ্যে এক চিকিৎসক অপর জনকে খুঁজতে সেমিনার হলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দেখা পাননি। ওই চিকিৎসক বয়ানে জানান, সেই সময় সেমিনার হলের দরজা আংশিক খোলা ছিল এবং নির্যাতিতা সেমিনার হলে ঘুমোচ্ছিলেন। এই নিয়েও কিছুই মন্তব্য করতে চাননি দোষী সিভিক ভলান্টিয়ার। এর পরে সেমিনার হল এবং নির্যাতিতার দেহ উদ্ধার হওয়া প্রসঙ্গে আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয় সঞ্জয়কে। তাঁর উত্তর ‘বলতে পারব না’ থেকে বদলায়নি।
নির্যাতিতার অর্ধনগ্ন দেহ উদ্ধার, শরীরের ক্ষতিচিহ্ন— কিছু নিয়েই কোনও মন্তব্য করতে চাননি সঞ্জয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে যে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। সেখানেও একই জবাব সঞ্জয়ের— ‘বলতে পারব না’।
যদিও যাবতীয় তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করার পর্যাপ্ত প্রমাণ পেয়েছেন বিচারক দাস। সোমবার তাঁর শাস্তি ঘোষণা করেছেন বিচারক। আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়েছে সঞ্জয়কে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy