সঞ্জয় রায়। —ফাইল চিত্র।
আরজি করের মহিলা চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দোষী সঞ্জয় রায়কে যাবজ্জীবন শাস্তি দিয়েছেন বিচারক অনির্বাণ দাস। সাজা ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘‘বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ নয়!’’ তা বিবেচনা করেই ফাঁসি নয়, যাবজ্জীবনের শাস্তি দেন বিচারক। কেন বিচারক ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনার মধ্যে সঞ্জয়ের অপরাধকে ফেললেন না, তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই প্রশ্ন তুলে জানিয়ে দেন, তিনি সঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতেই অনড়। সেই প্রশ্নেরই উত্তর মিলল বিচারক দাসের নির্দেশনামায়। ১৭২ পাতার সেই নির্দেশনামায় ফাঁসি না দেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিচারক। দুপুরে সাজা ঘোষণা হলেও তখনই সঞ্জয়কে আদালত থেকে বার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যার পর বিচারক দাসের নির্দেশনামার প্রতিলিপি আদালতের ওয়েবসাইটে ‘আপলোড’ হওয়ার পরই আদালত থেকে বার করা হয় সঞ্জয়কে। নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেলে।
বিচারক তাঁর নির্দেশনামায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘যাবজ্জীবন হল নিয়ম। আর মৃত্যুদণ্ড হল ব্যতিক্রম।’’ তবে নির্দেশনামাতে তিনি অপরাধের নৃশংসতার কথা লিখেছেন। বিচারক দাসের কথায়, ‘‘এটা জঘন্য প্রকৃতির অপরাধ। নির্যাতিতার নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। দোষীর যৌন লালসার তৃপ্তির জন্য নির্যাতিতার জীবন দিতে হল।’’ এই মামলায় রায় দেওয়ার সময় বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন বিচারক। অপরাধের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিচারক দাস উল্লেখ করেন, ‘‘মামলার মুখ্য বিচার্য ছিল অপরাধের নৃশংসতা। গলা টিপে শ্বাসরোধ করা এবং যে ভাবে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে, তা সাধারণ অপরাধের মধ্যে পড়ে না।’’ সঞ্জয় যা যা ঘটিয়েছেন, তা অপরাধের পরিভাষায় ‘সিরিজ়’ বলে উল্লেখ করেছেন বিচারক দাস।
বিচারক আরও জানান, নির্যাতিতার অসহায়তার বিষয়টিও এই মামলায় অন্যতম বিচার্য ছিল। এ ছাড়াও এ ধরনের অপরাধের সমাজিক প্রভাবকেও উপেক্ষা করা যাবে না বলে জানান বিচারক দাস। নির্দেশমানায় তিনি জানান, অপরাধের ধরন সমাজে ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। তবে তার পরেও তিনি কেন সঞ্জয়ের অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে মনে করলেন না তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বিচারক দাস তাঁর দীর্ঘ নির্দেশনামার একটা বড় অংশ জুড়েই অপরাধের নৃশংসতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে কী কী তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষ্যগ্রহণের ভিত্তিতে সাজা ঘোষণা করেছেন, সে কথাও জানিয়েছেন বিচারক। তাঁর মতে, কোনও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়ার সময় আদালতকে অনেক বিষয়ের উপর নজর রাখতে হয়। অপরাধের ধরন দেখেই তার সাজা শোনানো হয়। সেই বিষয়ের কথা বলতে গিয়ে বিচারক দাস উল্লেখ করেছেন, ‘‘অপরাধের নৃশংসতা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেই আবহে মৃত্যুদণ্ডের দাবি আরও জোরালো করে।’’ তবে এ ক্ষেত্রে এ-ও মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন এবং বিচারের মাধ্যমে সংস্কারের সুযোগের কথাও।
মৃত্যুদণ্ড না-দেওয়ার কারণ হিসাবে বিচারক দাস সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার কথা উল্লেখ করেন। বচ্চন সিংহ বনাম পঞ্জাব সরকারের ১৯৮০ সালের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ‘ঐতিহাসিক’ রায়ের কথা বলেন বিচারক। তিনি জানান, ওই মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে শীর্ষ আদালতের কিছু নীতি-নির্দেশ রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সেই নীতি-নির্দেশে উল্লিখিত কঠোর মানদণ্ডের সঙ্গে আরজি করের ঘটনাকে মেলানো যায় না। তাই এই অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা বলা চলে না।
নির্দেশনামায় বিচারক দাস উল্লেখ করেন ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উচিত ‘চোখের বদলে চোখ’ বা ‘দাঁতের বদলে দাঁত’ বা ‘নখের বদলের নখ’ বা ‘প্রাণের বদলে প্রাণ’- এর মতো প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তিগুলি থেকে সরে আসা। বর্বরতাকে বর্বরতা দিয়ে বিচার করা উচিত নয়।
বিচারক দাস জানান, কোনও অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে তখনই ধরা হবে, যখন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না। রায় ঘোষণার সময় তথ্যপ্রমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদালত আইনি তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করেই রায় দেয়। সংগঠিত অপরাধ নিয়ে সমাজ কী বলছে, মানুষের ভাবাবেগ কী, তা দূরে সরিয়ে রেখেই রায় দিতে হয় বিচারককে। আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের মামলাতে এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেই ভাবাবেগে ভেসে না-গিয়ে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয়েছে। বিচারক দাস মনে করেন, মৃত্যুদণ্ড তখনই দেওয়া উচিত, যেখানে সংস্কারের কোনও জায়গা নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্কারের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলেই নির্দেশনামায় উল্লেখ করেন বিচারক দাস।
৫৯ দিনের বিচারপ্রক্রিয়া শেষে গত শনিবার সঞ্জয়কেই দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬ এবং ১০৩(১) ধারায় তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। সোমবার সিবিআই আরজি কর-কাণ্ডকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা বলে আদালতে উল্লেখ করে সঞ্জয়ের ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’র দাবি করে। কিন্তু বিচারক সাজা ঘোষণার সময় জানান, সিবিআইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন তিনি। ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা বলে মনে করেন না। বিচারক জানান, তিনটি ধারাতেই সঞ্জয়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। আমৃত্যু জেলে থাকতে হবে তাঁকে। একই সঙ্গে সব মিলিয়ে এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয় সঞ্জয়কে। কেন তিনি মৃত্যুদণ্ড দিলেন না, কেন এই অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা বলেননি, তা নিজের রায়ের নির্দেশনামায় ব্যাখ্যা করলেন বিচারক দাস।
(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy